নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আচরণ থেকে অমুসলিমদের সাথে সদ্ব্যবহার ও সদাচারের এমন ঘটনাবলী পাওয়া যায় যা অন্যান্য জাতি বা সম্প্রদায়ের ইতিহাসে একান্তই বিরল। কুরআনের আয়াতসমূহের প্রতি গভীর মনোযোগ সহকারে পূর্ণাঙ্গ তথ্য অনুসন্ধান করলে এ সম্পর্কিত ভ্রান্তির নিরসন হতে পারে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে ঠিকই। আবার অনেক আয়াতে তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বন্ধুত্ব, অনুগ্রহ, সদ্ব্যবহার ও সমবেদনা এ বিষয়গুলোর প্রত্যেকটির স্বরূপ বিশ্লেষণ করার পর কোন পর্যায়ে ইসলামের কি নির্দেশ রয়েছে তা ব্যক্ত হলেই অন্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের সীমা চিহ্নিত করা সহজ হবে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে কতিপয় স্তরে বিভক্ত করা যায়। যথা : বন্ধুত্ব ও ভালবাসা, সমবেদনা, সৌজন্য ও আতিথেয়তা, সমঝোতা এবং লেনদেনের স্তর। প্রত্যেকটি স্তরের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন নির্দেশ ও নীতিমালা রয়েছে।
বন্ধুত্ব : অমুসলিম ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের সাথে মুসলমানদের বন্ধুত্ব বা ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে না। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে মানুষের আগমন হয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। অন্য প্রাণী, বৃক্ষ-লতা কিংবা জড়পদার্থের মত মানব জীবন ইহজগত সর্বস্ব নয়। যে উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে মানুষকে এ জগতে পাঠানো হয়েছে, মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রা ও ক্রিয়াকলাপ তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে হবে। আল্লাহর ইবাদত তথা দাসত্ব ও আনুগত্য মানব জীবনের লক্ষ্য। অতএব, তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে, এমন কোন কাজ-কর্ম তার জন্যে অনুমোদিত নয়। অমুসলিম ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্বের ফলে মুমিনের ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণে কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে মুসলমানদেরকে অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার মত ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ের চেয়ে সামাজিক পর্যায়ে অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে মুসলমানদের আন্তরিক সম্পর্ক অনেক কুফল বয়ে আনতে পারে। ঘনিষ্ঠতার সুবাদে মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ বিষয় অবগত হয়ে তারা এমন পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ লাভ করবে যাতে মুসলমানদের সমূহ বিপদ ঘটতে পারে। তাই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে খুবই সতর্কতার প্রয়োজন হয়। আধুনিক সভ্যতায় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো পরস্পরে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ না করলেও এ সম্পর্কে কেউই একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে দেয়া না। উদ্দেশ্যে একটাই। আর তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।
সমবেদনা : সহানুভূতি প্রকাশ, হিত কামনা ও উপকার করার ক্ষেত্রে মুসলমান-অমুসলমানে কোন পার্থক্য নেই। যাদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান এমন অমুসলিম ব্যতীত সবার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করা যায়। অমুসলমানদের উপকার করার কোন বাধা তো নেইই বরং ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম জনগণ এক্ষেত্রে মুসলমান নাগরিকের সমান হকদার। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের জীবনে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ রেখে গিয়েছেন। জনৈক ইহুদী বালক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আসা-যাওয়া করতো। একদিন তিনি ছেলেটিকে দেখতে না পেয়ে তার খোঁজ নিলেন। জানা গেল, ছেলেটি অসুস্থ। তিনি তৎক্ষণাত তার বাড়িতে গিয়ে তার সেবা-শুশ্রুষা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তিনি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে ছেলেটি তার পিতামাতার সম্মতিক্রমে মুসলমান হয়ে যায়। অমুসলিম নাগরিকের সেবা করার এমন প্রচুর ঘটনা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনে দেখা যায়।
মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে সাহায্য প্রেরণ করেন। অথচ এরাই অমানুষিক অত্যাচার ও নিপীড়ন করে মুসলমানদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। ওমর রা. মুসলমানদের মত অমুসলিম দরিদ্রদেরকেও বায়তুল মাল থেকে সহযোগিতা প্রদান করতেন। কুরআন মজীদে মুসলমানদের প্রতি এরূপই নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধরত নয় এবং মাতৃভূমি থেকে তোমাদের বহিষ্কার করেনি তাদের সাথে দয়া ও ন্যায়বিচারের ব্যবহার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না।’ (মুমতাহিনা:৮) ন্যায়বিচার ও সদ্ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিম, চুক্তিতে আবদ্ধ অমুসলিম এবং শত্রু অমুসলিম সবাই সমান।
সৌজন্য ও আতিথেয়তা : বাহ্যিক সদাচার ও সৌজন্যের ক্ষেত্রে অমুসলিমদের কোন শ্রেণীবিভেদ নেই। এমনকি যুদ্ধরত অমুসলিমরাও সৌজন্যমূলক ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য। কাফেররা আত্মীয় হলেও তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা যাবে না, এ নির্দেশ নাযিল হবার পর সাহাবায়ে কেরাম এই নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়িত করেন। এরফলে ঘরে ঘরে পিতা পুত্রের সাথে এবং পুত্র পিতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। যদিও মানব প্রকৃতি ও সহজাত প্রবণতার জন্যে এরূপ করা সহজ ছিল না। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের নির্দেশাবলী পালনের ব্যাপারে নিজেদের প্রবৃত্তি ও পারস্পরিক সম্পর্কের পরওয়া করতেন না। তাই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এ ব্যাপারে একটি মূলনীতি জানিয়ে দেন। বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা করতে নিষেধ নেই।