স্বাধীনতার মাস মার্চেই বাংলাদেশ পাচ্ছে উন্নয়নশীল শিরোপা
বাকি মাত্র কয়েকটা দিন। আগামী ২০ মার্চ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এ উত্তরণকে স্বাধীনতা-পরবর্তী জাতীয় জীবনের বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্বাধীনতার মাস মার্চ বাংলাদেশের জন্য আসছে এ স্বীকৃতি।
এ অর্জন উদযাপনের জন্য বড়সড় প্রস্তুতিও নিয়েছে সরকার। আগামী ২২ মার্চ এ অর্জনের জন্য সংবর্ধনা দেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। একইদিন সারা দেশে আয়োজন করা হবে আনন্দ মিছিল। এ আনন্দ উৎসব চলবে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত।
উন্নয়নকে টেকসই করতে মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সূচক তৈরি করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এরই ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ- তিন শ্রেণিতে ভাগ করে সিডিপি। বাংলাদেশসহ ৪৮টি দেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় আছে। প্রতি তিন বছর পরপর জাতিসংঘের সিডিপি এ তালিকায় থাকা দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে।
জানা গেছে, একটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে (ডেভেলপিং কান্ট্রি-ডিসি) পরিণত হতে গেলে যে তিন সূচকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। বাংলাদেশ সেই তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। প্রথম শর্তে দেশে মাথাপিছু আয় ১২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, যা বাংলাদেশ অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। এখন দেশে মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় শর্তে মানবসম্পদের উন্নয়ন, অর্থাৎ দেশের ৬৬ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯ ভাগ। আর তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩২ ভাগের নিচে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ মাত্রা ২৫ ভাগ।
এসব শর্তপূরণ হওয়ায় বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে। জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাউন্সিলে পাস হওয়ার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হয়ে উঠবে বাংলাদেশ। তবে ছয় বছর পর্যবেক্ষণ ও নানা আনুষ্ঠানিকতার পর বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত মর্যাদা দেবে জাতিসংঘ।
এরই মধ্যে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ও ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সিপ্পোও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশকে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এ ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য একটি সুখবর হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় গেলে আমাদের মর্যাদা বেড়ে যাবে। বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিশ্বের সব দেশের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী বলে বিশ্বের কাছে বিবেচিত হয়। এর ফলে উন্নয়নশীল হওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়, সেটা অনেকাংশেই কমে যাবে। ফলে দেশে-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়বে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ঋণ দিতে আগ্রহী হবে।
উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে, বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে না পারলে ফের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। তারা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট রাখা চলবে না। যে কোনো সহিংসতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এ অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এলেও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো আরও ১০ বছর পাবে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাডের এলডিসি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৭ সাল পর্যন্ত এ সুবিধাগুলো পাবে বাংলাদেশ।
আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়: ড. আতিউর রহমান
এটা খুবই ভালো একটা খবর। বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে। তবে এ বছর আমাদের একটা মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে, ২০২৪ সালে এটা একটা কাঠামোর মধ্যে দাঁড়াবে। তারপর পরীক্ষামূলকভাবে থাকবে। স্বল্পোন্নত দেশের আমাদের যে সুযোগ-সুবিধাগুলো-তা উঠে যাবে না। তবে সাফল্যের পেছনে যেটা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে-রপ্তানি খাত। গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির মাধ্যমেই ছয়-সাত বছর ধরে চলমান থেকে গ্রোথ রেট ৬ পার্সেন্টের ওপরে গেছে। এটা বড় কারণ।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আমাদের বিপুল উন্নতি হয়েছে। যে কারণে হিউম্যান ডেভেলপমেন্টও বেড়েছে। তৃতীয়ত, আমাদের ইকোনমিক ভালনারেবিলিটিও সেটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। কারণ, আমাদের বিদেশি ঋণের লায়াবিলিটি খুব কম। রেমিটেন্স ও রিজার্ভ ভালো। সব মিলিয়ে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। যে কারণে আমরা এ জায়গায় আসতে পেরেছি। এ জায়গাগুলোতে আমরা ভালো করছি ঠিক, যখন উন্নয়নশীল দেশ হব-আরও কতগুলো কাজ করতে হবে। আমাদের ইনভেস্টমেন্ট বাড়াতে হবে। ফরেন ডাইরেক্ট প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট বাড়াতে হবে। বিনিয়োগের পরিবেশ সবসময় উন্নত রাখতে হবে। স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে হবে অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষার সুযোগের পাশাপাশি দক্ষতাও বাড়াতে হবে। এ কাজগুলো যদি করতে থাকি তাহলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উতরে যেতে পারবে। ২০২৮ সালে আমরা পুরোপুরি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হব।
আমাদের অর্থনৈতিক যে অবস্থা-তিনটি সূচকে আমরা একসঙ্গে উন্নতি করছি। যেটা পৃথিবীতে নেই; কোনো স্বল্পোন্নত দেশ করেনি। বাংলাদেশই করতে পারছে তিনটি সূচকে একসঙ্গে আমরা উন্নয়ন করতে পারছি। মিনিমাম লিমিট যেটা থাকা দরকার তার চেয়ে ভালো করছি তিনটা সূচকেই। এটা বাংলাদেশের জন্য স্থিতিশীল অর্থনীতির লক্ষণ। এটা ধরে রাখতে হবে। বিনিয়োগ বাড়িয়ে, স্কিল বাড়িয়ে জায়গাটা ধরে রাখতে পারলে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আবার আরেকটি রিভিউ হবে। আমার ধারণা, সেই রিভিউতেও আমরা ভালো করব।
এ বছরই আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঢুকে যাব। ২০২৪ সালে এটা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে। ২০২৮ সালে গিয়ে পুরোপুরি চলে যাব। এটা ভালো লক্ষণ। বাংলাদেশের জন্য গৌরবের বিষয় হতে যাচ্ছে। যদিও আমাদের বিনিয়োগের কস্ট বাড়বে, প্রাইভেট ইনভেস্টের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হতে হবে। সরকারের যেসব লোন, স্কলারশিপ, ট্রাভেল গ্র্যান্ট-এসব পাওয়া হয়তো কমে যাবে। কিন্তু এগুলো পরিমাণের তুলনায় খুব কম। দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
বাংলাদেশ সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছবে: কাজী খলীকুজ্জমান
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে যাচ্ছে, এটা এখন সবাই জানে। মার্চের ২২ তারিখে জাতিসংঘ ঘোষণা করবে, আমরা উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছি। তিনটা শর্ত লাগে, এ তিনটা শর্তই আমরা পূরণ করতে পেরেছি। কিন্তু এর মানে এই না, আমরা সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসেছি। তিন বছর পর ২০২১ সালে আবার মূল্যায়ন করবে। তখনো যদি আমাদের এ অবস্থা থাকে, কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না হয় তাহলে আরও তিন বছর লাগবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে। ২০২৪ সালে বের হব। এখন যে মূল্যায়ন হয়েছে, তার তিনটা শর্তই পূরণ করেছি আমরা। শর্ত পূরণ হয়েছে, তার মানে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাইনি। জাতিসংঘের নিয়ম হচ্ছে-দুবার তারা দেখে। এটা প্রথমবার। তিন বছর পর আবার মূল্যায়ন হবে। আমার ধারণা, তখনো আমরা ভালো করব। তারপরে প্রক্রিয়াজাত করতে আরও ২-৩ বছর সময় লাগবে। মোটামুটি ২০২৪ সাল পর্যন্ত পৌঁছাবে।
উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে ২০২৪ সালের পরে। শুল্ক কমার পাশাপাশি আরও কিছু সুবিধা আছে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়, বাংলাদেশের সম্মান বাড়বে। ঋণ পাওয়ার পথ সুগম হবে। আগে থেকে আমাদের শুল্ক কমে যাবে, অন্যদিকে আমরা আনুষঙ্গিক খরচ কমাতে পারলে লাভবান হব।
মোট কথা, আমাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে হবে। যাতে সম্মান আরও উঁচু হতে পারে। স্বল্পোন্নত দেশ থাকা আসলে অসম্মানের ব্যাপার। এর মাধ্যমে আমরা সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছতে পারব।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে: আবু আহমেদ
উন্নয়নশীল দেশ হওয়া বাংলাদেশের জন্য কৃতিত্ব। এটা ভালো দিক। খুশির কথা। এতদিন আমরা লিস্ট ডেভেলপ কান্ট্রি ছিলাম। মানে সারা বিশ্বের অনুন্নত ১৪৭টি দেশের একটি ছিলাম। এখন উন্নয়নশীল দেশ হচ্ছি। আমাদের ওপরে রয়েছে ভারত-পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। এরা হয়ে গেছে আরও আগেই। সেই ব্লকেই আমরা এখন যোগদান করছি। এতে আমাদের সম্মান বাড়বে। বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ পাবে। তারা ধরে নেবে, বাংলাদেশ ঠিকভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। নইলে উন্নয়নশীল দেশ হলো কীভাবে! বিদেশি বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে ভালো সুবিধা পাওয়া যাবে। আমরা প্রতিযোগিতা করতে পারব।
প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই এগুতে হবে। উজ্জ্বল হবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি। এটা হচ্ছে প্রাথমিক স্তর, পরেরটা পেরুতে পারলেই সেটাই হবে সত্যিকারের সাফল্য। আগে প্রাথমিক স্তরটাই পার হোক। তারপর দেখা যাবে। বাংলাদেশ যদি ৮ পার্সেন্ট হিসেবে জিডিপি গ্রোথ অর্জন করতে পারে তাহলে অনেক সহজ হয়ে যাবে। এখন তো ৭.৩ পার্সেন্ট। প্রবৃদ্ধিটা আরও বেশি হতে হবে।
বিনিয়োগ বাড়লে ভৌত অবকাঠামো দাঁড়াবে, জিডিপি ৮ পার্সেন্টে উন্নীত হয়, রপ্তানি বাড়তে হবে। তবেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।