গাজীপুরের তরুণের বইটি যেভাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের হাতে
এবারের একুশে বইমেলায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জীবনী নিয়ে লেখা তরুণ লেখক হাফিজুর রহমানের বই ‘এরদোয়ান দ্যা চেঞ্জ মেকার’ প্রকাশিত হয়। অবাক করা বিষয় হলো বাংলা অক্ষরে লেখা সেই বইটি চলে গেছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের হাতে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট গতকাল হাফিজুরের হাত থেকে বইটি গ্রহণ করেছেন। সেই দৃশ্য প্রচারিত হয়ে তুরস্কের অনেকগুলো টেলিভিশনে। গাজীপুরের এই তরুণকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে জোর আলোচনা।
এ সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী জনাব বিনালি ইলদিরিম, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, একে পার্টির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং সকল এমপিরা উপস্থিত ছিলেন। হাফিজুর রহমান নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু এই অসাধ্য কাজ একক প্রচেষ্টায় কীভাবে করলেন হাফিজুর? সেই প্রশ্ন যখন সবার মুখে তখন হাফিজুর নিজেই জানালেন দীর্ঘ এই গল্পটা।
হাফিজুর বলেন, তুরস্কের মাননীয় প্রেসিডেন্ট, যে মহান নেতাকে নিয়ে বইটি লেখা জনাব রেজেপ তায়্যিপ এরদোয়ানের হাতে বইটি তুলে দিচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ, জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্তু ছিল সেটি। আপনাদের সালাম ও ভালবাসা পৌছে দিয়েছি। উনি অনেক খুশি হয়েছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং আপনাদেরকে ভালোবাসা ও সালাম পৌঁছাতে বলেছেন।
বইটি প্রকাশের পর বাংলাদেশি পাঠকদের আগ্রহ, আবেগ ও ভালোবাসা যতটুকু পেয়েছি সম্ভবত তার চেয়ে কোনও অংশেই কম ছিলনা তুর্কিদের। যিনিই বইটি সম্পর্কে জেনেছেন তিনিই এতবেশি খুশি হয়েছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। যেগুলোর বিস্তারিত লিখতে গেলে এই লেখা শেষ হবেনা তাই পরবর্তীতে লিখবো। বই প্রকাশ হওয়ার পর সম্ভবত সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন তুরস্কের অন্যতম সিভিল সোসাইটি সংগঠন ইয়েনি দুনিয়া ভাকফির চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি মাহমুদ গুকসু এবং আনকারা শাখার সভাপতি আলি তকুয কেননা আমি এই সংগঠনের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের সভাপতির দায়িত্বে আছি।
তিনি বলেন, বই হাতে পাওয়ার পর আলি তকুয সাহেব এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে, উনি পারলে সেদিনই মাননীয় প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিবেন! আমার অনেক আগে থেকেই একটি স্বপ্ন ছিল জনাব এরদোয়ানের জন্মদিন ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি, সেদিন ছোট্ট একটি উপহার হিসেবে হাতে তুলে দিবো। যদিও শুরু থেকেই একটা শঙ্কা ছিল, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মতো একজন মহান ও ব্যস্ত মানুষের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া কি আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে? যাইহোকে, প্রেসিডেন্টের আফ্রিকা সফর থাকায় ২৬ ফেব্রুয়ারি তা আর সম্ভব হয়নি।এরপর অপেক্ষার পালা। মাহমুদ গুকসু সাহেব আর আলি তকুয সাহেব এপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন। গত বৃহস্পতিবার বললেন যে, আগামী মঙ্গলবার হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। দেখা যাক।
কিন্তু ওনাদের কথায় আমি খুব বেশি আশ্বস্ত হতে পারিনি। এর মাঝে শনি ও বরিবার সরকারি ছুটি। তাই কাজ এগোয়নি। যদিও মাহমুদ সাহেব বলছিলেন আমি কথা বলে রেখেছি, সোমবারে সব ফাইনাল করবো হয়তো। সোমবার সকালে তুরস্কের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদপত্র সাবাহ পত্রিকার সাথে একটা ইন্টারভিউ ছিল। সকাল ১১ টায় বই নিয়ে প্রায় দেড়ঘণ্টা ব্যাপী অনেক কথা বললাম সেই ইন্টারভিউতে। এরপর আরেকটি এপয়েন্টমেন্ট ছিল চাঁদের দূতাবাসে, ইয়েনি দুনিয়া ভাকফির পক্ষ থেকে মতবিনিময়। চাঁদ দূতাবাসে চমৎকার একটি সেশন শেষে উপরোক্ত দুজন, আরেকজন সাবেক এমপির সাথে সংসদ ভবনের দিকে রওয়ানা দিলাম। সংসদ ভবনে গিয়ে সরাসরি একে পার্টির সংসদীয় দলের উপনেতার রুমে গেলাম।
হাফিজুর বলেন, তখন একে পার্টির পার্লামেন্টারি গ্রুপ পরিচালনা কমিটির মিটিং চলছিল যেখানে মঙ্গলবারের মিটিংয়ের এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমরা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মিটিং শেষ হয়। মাহমুদ সাহেব উপনেতার কাছে বইটি দিয়ে আগামীকালের অধিবেশনে প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনুমোদন দেওয়ার কথা বললেন। উপনেতা জানালেন, অধিবেশনের এজেন্ডার খসড়াগুলো আমরা তৈরি করি কিন্তু অনুমোদন করে দলের প্রেসিডিয়াম বডি। কিছুক্ষণ পরেই সেই মিটিং শুরু হবে, আমি সেখানে পেশ করবো, পাশ হলে আপনাদের জানাবো, আপনারা সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন।
তিনি বলেন, পার্লামেন্ট থেকে বের হয়ে উনাদের সাথে বন ও পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলাম, সেখানে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টাকে বই গিফট করলাম। কিন্তু আমার পুরো মনোযোগ সংসদ ভবনের আপডেটের দিকে। সন্ধ্যায় উনারা আমাকে আমার বাসায় যাওয়ার স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে উনাদের কাজ কনটিনিউ করলেন। আমি হাতে থাকা সামান্য কাজ শেষ করে মাগরিবের নামাযের জন্য মসজিদে ঢুকবো এমন সময় মাহমুদ সাহেবের ফোন!খুশি মনে রিসিভ করলাম। কিন্তু না, এখনো শিউর না। বই নিয়ে তুর্কি ভাষায় ছোট্ট সামারি করে পাঠাতে বললেন। পাঠিয়ে নামায শেষে বাসে উঠলাম।
সোশ্যাল মিডিয়ায় হাফিজুর উল্লেখ করেন, আমার বাসা আনকারার (আঙ্কারা) এক প্রান্তে তাই মোটামুটি ঘণ্টাখানেক সময় লাগে সেন্টারে আসতে। বাসে উঠলে এমনিতেই পথ শেষ হতে চায় না। কিন্ত সেদিন পথিমধ্যে নামতে হলো, যেখানে এক বন্ধুর সাথে চা পানে শরিক হলাম। এমন সময় মাহমুদ সাহেবের পরবর্তী ফোন, এবার শিউর্। আগামীকাল সকাল ৮.৩০ টায় একসাথে হবো এরপর রওয়ানা দিবো। আমি আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম। উনি আরও বললেন, সাথে সর্বোচ্চ দশজন যাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা ৫ জন মুরুব্বী যাবো আর তুমি, তোমার সহকর্মীদের মধ্য থেকে মোট পাঁচজন ঠিক করো। কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেলাম । কাকে রেখে কাকে নিবো! সবাইতো প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে সাক্ষাতের জন্য উন্মুখ, তাও এতো কাছ থেকে দেখার সুযোগ। অবশেষে ইয়েনি দুনিয়া ভাকফিতে দায়িত্ব পালন করা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশ থেকে চারজন প্রিয় সহকর্মীকে ঠিক করলাম।
অবর্ণনীয় অনুভূতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি বন্ধুর সাথে চা পর্ব শেষে বাসে উঠলাম কিন্তু পথ আর শেষ হয়না, কেমন যেন এক ফিলিংস। বাসায় পৌঁছলাম। আমার মেয়েটা দুদিন ধরে অসুস্ত। তার সাথে ও পরিবারের সাথে কিছুটা সময় দিলাম। এরপর ঘুমাতে গেলাম কিন্তু রাতে ঠিকমতো ঘুম হলোনা। কিছুক্ষণ পরপর জেগে যাই! সেই এক অপেক্ষা!
ইয়েনি দুনিয়া ভাকফিতে সকালে একত্রিত হয়ে কিছু কাজ শেষে সাড়ে নয়টার দিকে রওয়ানা দিলাম। দশটার দিকে সংসদ ভবনে পৌঁছলাম। প্রয়োজনীয় প্রোটেকলের কাজ শেষ করে অধিবেশন রুমে গেলাম। ততক্ষণে কানায় কানায় পূর্ণ অধিবেশন কক্ষ বিশেষ করে ভিজিটরস গ্যালারি, তিল ধরার ঠাই নেই। কোনওমতে জায়গা পেলাম। ভিজিটরস গ্যালারির স্টেজের কোণের গেটের কাছে অবস্থান নিয়ে এবার ফাইনাল অপেক্ষা শুরু। একে একে এমপিরা, মন্ত্রীরা আসলেন। সবাই প্রেসিডেন্টের আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উল্লেখ করে হাফিজুর বলেন, জনাব এরদোয়ান, সকাল সাড়ে এগারটার দিকে অধিবেশন কক্ষে ঢুকলেন। সাথে প্রধানমন্ত্রী জনাব বিনালী ইলদিরিম। স্পীকার গ্রুপ মিটিং শুরু করলেন। এ প্রোগ্রামে সাধারণত একটা এজেন্ডাই থাকে তা হলো প্রেসিডেন্টের বক্তব্য। প্রেসিডেন্ট বক্তব্য শুরু করলেন। প্রায় চল্লিশ মিনিটের সেই বক্তব্যে আফ্রিকা সফরসহ সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললেন। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য উপস্থিত সবাই যাদুর মতো গিলছে। স্লোগান চলছে। প্রেসিডেন্ট হিজরতের সময় আবু বকর (রা.) এর উদ্বিগ্নের সেই ঘটনা ও কুরআনের আয়াত থেকে পড়ে শোনালেন, ‘তোমরা ভয় পেয়োনা, চিন্তা করোনা, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।’
পার্লামেন্টে তাকভীর, আল্লাহু আকবরের ধ্বনি শুরু হলো। আমি তখন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এটা কি সেই তুরস্ক যেখানে আরবিতে আযান নিষিদ্ধ ছিল! এটা কি সেই তুরস্ক যেখানে ইসলামি পোষাক পরা, দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ ছিল! এটা কি সেই তুরস্কের পার্লামেন্ট ভবন যেখানে হিজাব পড়ার কারনে বিজয়ী এমপিকে শপথ পড়তে না দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল! এটা কি সেই তুরস্ক যেখানে সরকারি অফিসগুলোতে জামায়াতে নামায আদায় নিষিদ্ধ ছিল। চেঞ্জ মেকারের আরেকটি অপরুপ দৃশ্যের সাক্ষী হলাম।
তিনি বলেন, বক্তব্য চলা অবস্থায় প্রেসিডেন্টের প্রটোকল অফিসাররা বারবার এসে খবর নিয়ে যাচ্ছেন। অনুরোধ করছেন যেন বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই স্টেজের কাছাকাছি চলে আসি। গ্রুপ স্পিকারের টেবিলে এরদোয়ান: দ্যা চেঞ্জ মেকার বইটি দেখতে পেলাম। সবমিলে নিজের মধ্যে খুবই এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিল। টান টান এক উত্তেজনা।
সাড়ে বারোটার দিকে প্রেসিডেন্ট বক্তব্য শেষ করলেন আর ততক্ষণে প্রটোকল অফিসার আমাদেরকে স্টেজের কাছে নিয়ে গিয়েছেন। বক্তব্য শেষে ধন্যবাদ দিয়েই স্পিকার আমাদের স্টেজে ডাকলেন। প্রেসিডেন্ট স্পিকারের এনাউন্সমেন্ট শুনে আমার দিকে তাকালেন। আমি এগিয়ে গেলাম। উনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর কোলাকুলি করলেন। একে একে সাথে থাকা সহকর্মীদের পরিচয় করিয়ে দিলাম-নিজেরা পরিচিত হলেন।
এদিকে মিডিয়ার ক্যামেরাগুলো আমাদের দিকে তাক করে আছে, সকল টিভিতে লাইভ চলছে। প্রেসিডেন্টের হাতে বইটি তুলে দিলাম। আনুষ্ঠানিক ফটোসেশন শেষ হলো। উনাকে ধন্যবাদ দিলাম। এরপর বইয়ের ভেতরে কি আছে তার কিছুটা বর্ণনা করলাম। বই লিখার কারণ বর্ণনা করলাম যে, মাননীয় প্রেসিডেন্ট আপনি প্রায়ই বলেন ভালোবাসা একপক্ষ থেকে নয় বরং দুপক্ষ থেকে হতে হয়। আপনি আজকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে মজলুমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে ফিলিস্তিন, আরাকানসহ সকল মজলুমদের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন, সবাইকে ভালোবাসছেন। আর তাই আমার পক্ষ থেকে ছোট্ট এই ভালোবাসা।
এরদোয়ানের সাথে কথাবার্তা প্রসঙ্গে বলেন, উনি অনেক খুশি হলেন। ধন্যবাদ জানালেন, অভিনন্দন জানালেন। বললেন, তোমাকে আমি অনুরোধ করছি যতদ্রুত সম্ভব এটার তুর্কি ভার্সন করবা (যাতে আমরা পড়তে পারি), এরপর পারলে আরবি ও ইংরেজিতে অনুবাদ করবা।
এরপর আমি বইটা বাংলাদেশে কতটা জনপ্রিয় হয়েছে তা তুলে ধরে পাঠকদের ভালোবাসা ও সালামগুলো পৌছলাম। উনি সালাম গ্রহণ করে সবাইকে সালাম জানালেন।
পরিবারের খোঁজখবর নিলেন। আমার ওয়াইফও তুরস্কে সেটা জেনে আরও খুশি হলেন। দোয়া করলেন। এরপর বললাম আপনার সাথে সিঙ্গেল ছবি তুলতে পারলে খুশি হবো। উনি সাথে সাথেই প্রস্তুত হলেন। এতক্ষণে বই উনার পিএস সেখান থেকে তুলে নিয়েছেন। আমি আর বই খুঁজে পাচ্ছিনা। বই খুঁজতেছি এদিকে দেখি উনি হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। সামলে নিয়ে দ্রুত হাত মিলালাম, কতক্ষণ ক্যামেরাগুলো ক্লিক করলো। ইতিমধ্যে বই হাতে চলে আসলো, এরপর বই নিয়ে আবার ক্লিক।
হাফিজুর বলেন, সবশেষে আমরা উনাকে এই বিশাল সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।