সরাইলে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে নির্মিত হলো শহীদ মিনার
সরাইল প্রতিনিধি : সরাইলের কালীকচ্ছ বাজারে ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ৫ শতাংশ জায়গা গত ২৫-৩০ বছর ধরে ছিল অবৈধ দখলদারদের কবলে। জেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন একাধিকবার তাদের উচ্ছেদ করেছে। কিছুদিন পরই সিন্ডিকেটের সহায়তায় ৭-৮ জন দখলদার সেখানে ব্যবসা শুরু করতেন। সেখানকার সাধারণ লোকজনের সমস্যা হলেও ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। অবশেষে ৬৫ বছর পর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে ইসরাত ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন সরজমিনে উপস্থিত হয়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করেন। কোন রকমে নড়বড়ে অবস্থায় ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দাঁড়ানো শহীদ মিনারটিকে আগামী ভাষা দিবসের আগে সুন্দরভাবে নির্মাণ করার পরামর্শ দেন তারা। বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে স্থায়ীভাবে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের লক্ষ্যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েন বাজারের সকল ব্যবসায়ী। তাদের আহ্বানে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাড়া দেন দলমত নির্বিশেষে সেখানকার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালীকচ্ছ সদরে কোনো শহীদ মিনার ছিল না। বাজারের ব্যবসায়ী ও সরাইল প্রেস ক্লাবের তৎকালীন কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ মাসুদ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে ২০১৭ সালের ১০ই মার্চ এখানে শহীদমিনার নির্মাণের লক্ষ্যে একটি সভা আহ্বান করেন।
ওইদিনই সকলে মিলে ইউনিয়ন পরিষদের জায়গায় কোনো রকমে সকলের অংশ গ্রহণে ৪৩ হাজার টাকা খরচ করে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর এটির নামকরণ করা হয় ‘কালীকচ্ছ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’। এতে গাত্রদাহ শুরু হয় অবৈধ দখলদারদের। একই বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাসুদকে সভাপতি ও মো. সলিম উদ্দিনকে সম্পাদক করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসও ওই শহীদ মিনারেই পালিত হয়। কমিটি স্থায়ীভাবে চাকচিক্য বৃদ্ধি করে আধুনিক মডেলের একটি শহীদমিনার নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। দেশ প্রেমের টানে এ কাজে এগিয়ে আসেন বাজারের সকল ব্যবসায়ীরা। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারাও সহায়তার আশ্বাস দেন। শহীদমিনারের সামনের জায়গাটি ছিল অল্প। লোকজনের দাঁড়াতে কষ্ট হতো। সওজের জায়গার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের চিন্তা করে প্রশাসন। জায়গা ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু তারা দখল ছাড়েনি। ১৬ই ডিসেম্বরের আগে শহীদমিনারের সামনের জায়গা পরিষ্কার করে কালীকচ্ছ এলাকার সর্বস্তরের নারী-পুরষ ও শিক্ষার্থীদের মন ভরে শহীদমিনারে ফুল দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে- এমন প্রত্যয় নিয়েই সামনে এগুতে থাকে কমিটি। তাদের ডাকে এগিয়ে আসেন ইউপি চেয়ারম্যান মো. সরাফত আলী। চেয়ারম্যান শহীদ মিনারের সামনের জায়গা উদ্ধারের জন্য কমিটির মাধ্যমে নির্বাহী কর্মকর্তার শরণাপন্ন হন। মহৎ এ উদ্যোগকে সফল করার জন্য এগিয়ে আসেন ইউএনও উম্মে ইসরাত ও এসিল্যান্ড মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর তারা সেখানে পরিচালনা করেন উচ্ছেদ অভিযান। দিনভর অভিযান করে অবৈধ দখলদারমুক্ত করেন জায়গাটি। চমৎকার উন্মোক্ত পরিবেশে শহীদ মিনারটি এখান সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে একনজরে দেখা যায়। সেখানকার গত ৬০-৭০ বছরের পরিবেশই বদলে দিয়েছে এ শহীদ মিনারটি। সৌন্দর্য্য ও পরিধি বৃদ্ধির কাজ করতে থাকে কমিটি। গত দেড়-দুই মাস ধরে তারা দিনে রাতে শহীদ মিনারে কাজ করছেন। বাড়িয়েছে পরিধি। বাহারি টাইলস দিয়ে মুড়িয়েছে শহীদ মিনারের বেদি ও স্তম্ভ। সামনের সুন্দর মাঠটির সুরক্ষার জন্য তারা চারদিকে ইটা দিয়ে বসার জায়গা তৈরি করেছেন। পুরো মাঠটির ফ্লোর সলিং করে ঢালাইয়ের কাজ হাতে নিয়েছেন কমিটি। এ পর্যন্ত তারা শহীদমিনার নির্মাণে সাড়ে ৩ লক্ষাধিক টাকার খরচ করেছেন। এমন একটি শহীদমিনার পেয়ে সেখানকার লোকজন দারুণ খুশি। গতকাল মহান শহীদ দিবসে ভোর বেলায় রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি ভিন্ন বয়সের শতশত নারী-পুরুষ ও শিশুরা আনন্দে ভেসে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছে। দীর্ঘদিনের অপূরণীয় প্রত্যাশা পূরণ হওয়ায় তারা উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। শহীদমিনার নির্মাণ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মাসুদ ও সম্পাদক মো. সলিম উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার ৪৭ পর এ ইউনিয়নের মানুষকে একটি শহীদমিনার নির্মাণ করে দিতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে আসবে ফুল দিবে। ভাষা দিবস ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানবে। স্বদেশ ও স্বজাতির প্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। এতেই আমাদের আত্মা শান্তি পাবে। তবে এমন মহৎ কাজটির ইউএনও ও এসিল্যান্ড মহোদয়ের সহায়তার কথা কালীকচ্ছ বাসী ভুলবে না।