সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ
---
নিউজ ডেস্ক : রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার একটি গার্মেন্টসের লাইনম্যান মো. নাসরুল্লাহ বললেন, মাসে সর্বসাকল্যে তিনি বেতন পান সাড়ে ১৫ হাজার টাকা। টিনের ছাউনির আধা পাকা দুই রুমের বাসা ভাড়া পরিশোধে মাসে তাকে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। চতুর্থ ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া দুই সন্তানের পেছনে ব্যয় আছে তিন হাজার টাকা। যাতায়াত ও আনুষঙ্গিকে এক হাজার টাকা ব্যয় হয়। এরপর যে টাকাটা তার থাকে, তা দিয়ে কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন অতিবাহিত করছেন তিনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালানোর বাড়তি খরচ মেটাতে তিনি চাল কম কিনছেন। বড় কোনো অসুখ না হলে সহজে ডাক্তারের কাছেও যান না নাসরুল্লাহ। আর বড় কোনো বিপদ এলে গ্রামের জমি বিক্রি করা ছাড়া বিকল্প পথ নেই তার। দেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রাণভোমরা প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। যাদের অধিকাংশ ও সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছে। নাভিশ্বাস অবস্থা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী দিনে আরও দুর্দিন আসছে। বিশেষ করে আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরে ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ কর আরোপে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। এতে যেসব পণ্যের কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, দেখা যাবে, তাতেও অসত্ ব্যবসায়ীরা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে ভ্যাট আদায় করবে। সব চাপ পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা যায়, গত এক বছরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়েছে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। বিপরীতে আয় বেড়েছে ৬ থেকে ৮ শতাংশ। যেসব খাতে খরচ বেড়েছে এর মধ্যে রয়েছে-বাড়িভাড়া, নিত্যপণ্য, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, যানবাহনের ভাড়া এবং চিকিত্সা ব্যয়। ওই হিসাবে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশ বেশি। আর এই বাড়তি ব্যয় মেটাতে মানুষকে সীমাহীন কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। নিম্নআয়ের মানুষ বড় কোনো রোগ না হলে চিকিত্সা নিচ্ছে না। জীবনযাত্রার ব্যয়ের সূচক প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘নাম্বিও’ (.িহঁসনবড়.পড়স)। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি ১২১ দেশের সূচক প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি। অর্থাত্ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার চেয়ে বাংলাদেশের জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০১তম এবং ২০১৫ সালে ছিল ১০৯তম। পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি বছরই বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। ওই সূচকে আরও দেখা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয় সূচকে ১১৮তম দেশ পাকিস্তান, নেপাল ১১১তম এবং শ্রীলঙ্কা ১০৬তম অবস্থানে। রাজধানী ঢাকার জীবনযাত্রার মান বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ব্রিটিশ পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকার জীবনযাত্রার মান কানাডার মন্ট্রিয়াল শহরের সমান। তবে এ দুই শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধার তুলনা করা হাস্যকর। মন্ট্রিয়ালের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আর ঢাকার সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান বলে এতে মন্তব্য করা হয়। বিশ্বের ১৩৩টি শহরের ওপর পরিচালিত ওই জরিপে দেখা গেছে, জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে ঢাকা ও মন্ট্রিয়ালের অবস্থান ৭১তম। প্রতিবেদনে বলা হয় টরেন্টো, মেক্সিকো শহর, ক্লিভল্যান্ড এবং ইস্তাম্বুলের মতো শহরগুলোর জীবনযাত্রার ব্যয় ঢাকার চেয়েও কম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম সকালের খবরকে বলেন, বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের বাজারে নৈরাজ্য চলছে। বাজার কারও নিয়ন্ত্রণে নেই। অধিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাতে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে আছে। আখের গোচাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। প্রান্তিক কৃষকরা সঠিক মূল্য পান না আবার ভোক্তাদের পকেট কাটা দর রাখা হচ্ছে। তিনি বলেন, ভ্যাট আইন কার্যকরে সামনে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা নেই। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। গত বছরের শেষের দিকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২৬টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১০টি সেবামূল্য পর্যালোচনা করে জরিপ ফল প্রকাশ করে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এতে এক বছরে পণ্য ও সেবামূল্য বেড়েছে শতকরা ১২ দশমিক ১৭। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। আর সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশের ওপরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা তাদের সঞ্চয় ভেঙে চলেছেন। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়িয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নিত্যপণ্য ও বাড়ি ভাড়ায়। নতুন ভ্যাট আইন নিয়েও দুশ্চিন্তায় নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কারণ এতে ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ কর বসানো হবে। যার প্রভাবে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য বাড়বে। বাজেটে যেসব পণ্যের দাম কমানোর ঘোষণা রয়েছে, বাস্তবে তা কমতে বাজেট পাস হওয়ার পরও তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগে। কিন্তু কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা এলে পরের দিনই তা বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে কিছু কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আবার সেই পণ্যে সম্পূরক শুল্ক অনেক বাড়ানো হয়েছে। প্রকৃত করের আপাতন কোন খাতে বেশি হচ্ছে তা সুনির্দিষ্ট করা নেই। সুতরাং কোন পণ্যের দাম বাড়বে বা কমবে, তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, বাজেটে আগামী তিন বছরের জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধরা হয়েছে। এটা কবে কমানো হবে তাও বলা হয়নি। একবার কোনো পণ্যে দর বৃদ্ধি পেলে তা কমার নজির বাংলাদেশে নেই। সুতরাং নতুন ভ্যাট আইনে উত্পাদন ও জীবনযাত্রার ব্যয় যে বাড়বে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। দেবপ্রিয় আরও বলেন, চেয়েছিলাম এবারের বাজেট মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে না পারলেও যেন বাড়িয়ে না দেয়। দেশের শিল্প খাত, কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাতের উত্পাদন ব্যয় যাতে বেড়ে না যায়। দুটির একটিও এ বাজেটে রক্ষিত হয়নি। আগামী বছর জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। বাড়িভাড়া : ঢাকা শহরে নতুন বছরের শুরুতে অর্থাত্ জানুয়ারিতে একবার আবার জুন মাসে আরেকবার বাড়িভাড়া বাড়ানো হয়। ওই হিসাবে গত এক বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ২০ শতাংশ। গত বছর যে বাড়ির ভাড়া ছিল ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে গড়ে ওই বাড়ির ভাড়া ১২ হাজার টাকা। নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাম্প্রতিক তথ্যে উঠে এসেছে, নগরীর শতকরা ৭০ ভাগ মানুষই তাদের আয়ের অন্তত ৬০ শতাংশ ব্যয় করেন বাড়িভাড়া খাতে। পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সালে দেশে গড়ে বাড়িভাড়া বেড়েছে ১৪ দশমিক ৮৫ ভাগ। এর মধ্যে ২০০৯ সালে বেড়েছে ২৪ দশমিক ৪২, ২০১০ সালে ২২ দশমিক ২৫, ২০১১ সালে ১৪ দশমিক ২৭, ২০১২ সালের ১৯ দশমিক ৮৭, ২০১৩ সালে ১৬ দশমিক ১৮ এবং ২০১৪ সালে বাড়িভাড়া বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। যানবাহনের ভাড়া : প্রতি বছরই যানবাহনের ভাড়া বাড়ছে। গন্তব্য যত কাছেই হোক ঢাকা শহরে ১৫ টাকার কম রিকশা ভাড়া নেই। ফলে গত এক বছরে মানুষের যাতায়াত ২২ শতাংশ বেড়েছে। যানবাহনের ভাড়া ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের বিনোদন ও ভ্রমণ ব্যয় বেড়েছে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন ও কোচিং সেন্টারের খরচসহ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। লেখাপড়ার খরচের মধ্যে ভর্তি ফি এখন অনেক অভিভাবকের জন্য বোঝা। একই সঙ্গে স্কুলের বেতন। আগে যে স্কুলে বেতন ছিল ৩ হাজার টাকা, এখন তা হয়েছে ৫ হাজার টাকা। নতুন ভর্তির ক্ষেত্রে ডোনেশনের নামে নেওয়া হচ্ছে বেশি টাকা। ওই হিসাবে অন্য খাতের তুলনায় গড়ে লেখাপড়ার খরচ বেড়েছে। চিকিত্সা ব্যয় : গত এক বছর ধরে অব্যাহতভাবে বাড়ছে ওষুধের দাম। একই সঙ্গে ডাক্তারের ফি, ল্যাবরেটরি টেস্টের খরচ বেড়েছে। এক বছরে চিকিত্সা ব্যয় ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এ ছাড়াও মানুষের অন্য ব্যয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ।