‘অনেক পুরুষ আসতো, আমাকে ধর্ষণ করতো’
---
অনলাইন ডেস্ক : সোমালিয়ার আল-শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠী কেবল যে কেনিয়ার পুরুষদেরই দলে টানছে তা নয়, সংগঠনটি যৌনদাসী হিসেবে কেনিয়ার মেয়েদেরও আটক ও পাচার করছে। কেনিয়ার সালামা আলী যখন গত বছর তার নিখোঁজ দুই ভাইকে খোঁজা শুরু করেন তখন তিনি প্রতিবেশী দেশ সোমালিয়ার আল-শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে পারেন। খবর-বিবিসি বাংলা
ওই সংগঠনটি কেবল যে কেনিয়ার পুরুষদেরই দলে টানছে তা নয়, সংগঠনটি যৌনদাসী হিসেবে কেনিয়ার মেয়েদেরও আটক ও পাচার করছে। ঘন জঙ্গলে ক্যাম্পে নিয়ে মেয়েদের ধর্ষণ করছে আল-শাবাবের জঙ্গিরা। ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া নারীরা কোনো ধরনের সহায়তা ছাড়াই গভীর জঙ্গলে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। আর জঙ্গলে সেই সন্তানেরা বেড়ে উঠছে।
সালামা আলী নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহ এড়াতে গোপনে তাঁর ভাইদের খোঁজ শুরু করেন। মোম্বাসায় তিনি এমন সব নারীদের সঙ্গে দেখা করেন, যাদের পুরুষ আত্মীয়রা নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন তিনি। ‘জানতে পারলাম, আমার মতো অনেকেই রয়েছেন।’ -বলেন সালামা।
তবে জোর করে যেসব নারীদের সোমালিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের জীবনের ভয়াবহ কাহিনীর বিষয়েও জানতে পারেন তিনি। মোম্বাসা ও কেনিয়ার অন্য উপকূলীয় অঞ্চল থেকে খ্রিস্টান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের তরুণী ও বয়স্ক নারীদের জোর করে তুলে নেওয়া হয়। ওই নারীদের প্রথমে বিদেশে বা অন্য শহরে ভালো পারিশ্রমিকের কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং পরে তাঁদের অপহরণ করা হয়।
আল-শাবাবের বন্দীশিবির থেকে ফিরে আসা নারীদের সহায়তা দিতে গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন সালামা। এই সংগঠনের কথা জানতে পেরে নির্যাতিত নারীরা তাঁর কাছে ছুটে আসেন এবং ওই সংগঠনে যোগদান করতে চান। কজন নারী আসেন বাচ্চাসহ, কজন ছিলেন এইডসে আক্রান্ত। ভয়ংকর অভিজ্ঞতার শিকার এই নারীদের কেউ আবার মানসিকভাবে অসুস্থ। তাঁরা সবাই ভীত। আর ওই নারীদের মাধ্যমেই জানা যায় আল-শাবাবের বর্বরতার কথা।
“পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধা জন্ম দেওয়ার জন্য আল-শাবাবের সংগঠিত কর্মসূচি রয়েছে” জানান আল-শাবাবের সাবেক এক যোদ্ধার স্ত্রী সারাহ। অন্ধকার একটি ঘরে পর্দার আড়ালে থেকে বিবিসির সাংবাদিক নির্যাতিত এই নারীদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান।
আল-শাবাবের হাতে বন্দী থাকা ২০ জনের বেশি নারীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। এক নারী বলছিলেন “অনেক পুরুষ একের পর এক আসতো, আমাকে ধর্ষণ করতো। আমি তাদের সংখ্যাটা বলতে পারব না। তিন বছর প্রত্যেক পুরুষই আমার সঙ্গে শোবার জন্য এসেছে”।
“প্রতি রাতে একজন নারীর কাছে দুই থেকে তিনজন পুরুষকে আনা হতো। আমরা বারবার ধর্ষণের শিকার হতাম” -বলছিলেন নির্যাতনের শিকার আরেক নারী। নির্যাতনের শিকার নারীরা বলেন, তাঁদের কাউকে কাউকে জোর করে আল-শাবাবের জঙ্গিদের স্ত্রী বানানো হতো। আর অন্যদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
সোমালিয়ায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে আল-শাবাব। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। আল-শাবাবের হামলার শিকার হওয়া প্রতিবেশী দেশগুলো আফ্রিকান ইউনিয়নের বাহিনীর অংশ হিসেবে সেনা পাঠিয়েছে। এ ছাড়া আল-শাবাবের যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সোমালিয়ার সঙ্গে সীমান্ত এলাকার ঘন জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে আসছে কেনিয়ার সেনারা।
আল-শাবাবের হাতে বন্দী থাকা ২০ জনেরও বেশি নারীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরা সবাই জানিয়েছে, তাঁদের ঘন জঙ্গলে আটকে রাখা হয়েছিল। সালামার ওই সংগঠনের অন্যতম নতুন সদস্য হলেন ফেইথ (প্রতীকী নাম)। তিনি সম্প্রতি আল-শাবাবের হাত থেকে পালিয়ে এসেছেন।
ওই নারীর বয়স যখন ১৬ বছর, তখন এক দম্পতি তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৪ জন যাত্রীর সঙ্গে তাঁকে একটি বাসে তোলা হয়েছিল। তাদের যে পানি দেয়া হয়েছিল তাতে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো ছিল।
ফেইথ বলছিলেন, “চোখ মেলে দেখি, একটি ঘরে আমাদের রাখা হয়েছে। সেখানে দুজন পুরুষও রয়েছে। কালো কাপড় দিয়ে তারা আমাদের চোখ বেঁধে ফেলে। ওই ঘরেই তারা আমাদের ধর্ষণ করে”।
পরবর্তী সময়ে ফেইথকে আবার অচেতন করা হয়। জ্ঞান ফেরার পর তিনি দেখেন তিনি একটি ঘন জঙ্গলের ভেতর। সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। এরপর সেখানে তিন বছর কাটিয়ে দেন ফেইথ।
ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। ফেইথ বলছিলেন, “আমার দাদি ছিলেন ধাত্রী। তাই এ বিষয়ে আমার অল্প জ্ঞান ছিল। ঘন জঙ্গলে আমাকে একাই সবকিছু করতে হয়। শেষ পর্যন্ত আমি সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হই”।
বনের ভেতর ভেষজ গাছের সন্ধানে যাওয়া এক কবিরাজের মাধ্যমে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে পারেন ফেইথ। বনের মধ্যে তাঁর সন্তান নগ্ন অবস্থায় বেড়ে উঠছিল। এখন শহুরে জীবনে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে শিশুটির। শিশুটি রাতে ঘুমাতে পারছে না। ফেইথ জানান, বনের মধ্যে পশুর মতো বেড়ে ওঠায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল শিশুটি।
ফেইথ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন নারী এভাবেই বনের মধ্যে সন্তান জন্ম দেয়ার কথা বিবিসিকে জানিয়েছেন।
আল-শাবাবের সাবেক এক যোদ্ধার স্ত্রী সারাহ বলেন, “এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। পরবর্তী যোদ্ধা তৈরির জন্য এটা আল-শাবাবের সংগঠিত কর্মসূচির অংশ। তিনি বলেন, মানুষ জোগাড় করে সোমালিয়ায় ঘন জঙ্গলে ক্যাম্পে রাখা বেশ কঠিন। আর এ ক্ষেত্রে শিশুদের সহজে ব্যবহার করা যায়”।
“আমি যে ক্যাম্পে ছিলাম, সেখানে অনেক নারীকে দিয়ে ক্যাম্পে আরও নারী সরবরাহের কাজ করানো হতো। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য তারা নারীদের চাইত। ওই ক্যাম্পে থাকা ৩০০ নারীর বেশির ভাগই ছিল কেনিয়ার”-বলছিলেন সারাহ।