এই ছবিটা আপনাকে কাঁদাবে না
নীল রঙের হাফপ্যান্ট আর লাল শার্ট গায়ে ভূমধ্য সাগর উপকূলে উপুড় হয়ে পড়া থাকা সিরিয়ান শিশু আয়লানের নিথর দেহের মর্মস্পর্শী ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে কেঁদে ওঠে পুরো পৃথিবী। এরপর শিশু ওমর দাকনিশ। সিরিয়ার এই শিশুর রক্তাক্ত ধুলোমাখা শরীরের ছবি প্রকাশিত হলে আরও একবার ধাক্কা খায় বিশ্বমানবতা। খোদ হোয়াইট হাউজের তরফে বলা হয়, সিরিয়ায় যে যুদ্ধ চলছে তা কতটা বীভৎস হতে পারে, ওমরান দাকনিশের ছবিই তার প্রমাণ; যুদ্ধের ‘সত্যিকারের মুখ’।
কিন্তু এবার যে ছবিটা প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে এখনও ওই অর্থে কোনো আলোড়ন তৈরি হয়নি। প্রথমত ছবিটা মূলধারার কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ বা প্রচারিত হয়নি। দ্বিতীয়ত শিশুটির পরিচয় রোহিঙ্গা। ফলে এ নিয়ে হয়তো বিশ্ববিবেক জাগ্রত হবে না। হোয়াইট হাউজ থেকে কোনো বিবৃতিও আসবে না।
মালয়েশিয়া ভিত্তিক আরভিশন টিভিতে ছবিটি প্রচার হয়েছে। খবরে বলা হচ্ছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর গণহত্যা ও গণধর্ষণ থেকে রেহাই পেতে পলায়নরত রোহিঙ্গাবাহী নৌকায় গুলি চালিয়েছে দেশটির সীমান্তরক্ষী পুলিশ (বিজিপি)। গুলিতে তিনটি নৌকা ডুবে যায়। এতে চার শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়। নিখোঁজ ৩০ জনেরও বেশি।
৫ নভেম্বর মিয়ানমার সময় সকাল ৭টার দিকে নাফ নদীর তীরে দুটি শিশু এবং একজন নারীর মরদেহ পড়েছিল। যাদের মধ্যে একটি শিশুর পড়ে থাকার সঙ্গে শিশু আয়লানের মিল রয়েছে। হত্যার এই বিভৎস চিত্র দেখে অনেকেই মিয়ানমারের হাত থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের উদ্ধারে দেশটিতে জাতিসংঘের হস্ত—ক্ষেপেরও দাবি জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা পরিবারের শিশুদের পড়ালেখার কোনো সুযোগ নেই। ফলে এরা কিছুই শিখতে পারে না। বেড়ে ওঠে একরকম জেলখানায়। বিভিন্ন ক্যাম্প বা বস্তির বাইরে তাদের কোনো পৃথিবী নেই। স্কুলের ধারণাও তাদের নেই। সীমিত খাদ্য, সীমিত বস্ত্র আর খুপরি ঘরে ঠাসাঠাসি করে বেড়ে ওঠার ফলে এদের মানসিক বিকাশ ঘটে না। সমাজের মেইনস্ট্রিমের সঙ্গে মিশতে পারে না। নিজের ভেতরে নৈতিক মূল্যবোধও তৈরি হয় না। আত্মপরিচয় না থাকায় এরা বেড়ে ওঠে পরাজিত প্রজন্ম হিসেবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী সেখানে রোহিঙ্গা জাতির শিশুদের পড়ালেখার অধিকার স্বীকার করা হয় না। নানা প্রতিকূলতার ভেতরে মেট্রিক পাশ করতে পারলেও এরপরে কেউ কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে চাইলে ইমিগ্রেশন পাস বাবদ প্রতি দু’সপ্তাহে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ২৫০০ কিয়াত (বাংলাদেশী এক টাকায় ২০ কিয়াত) করে ট্যাক্স দিতে হয়। ফলে অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের কলেজের বারান্দা ডিঙানো হয় না।
মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জন্য মাধ্যমিক স্কুল আছে মাত্র দুটি। উচ্চশিক্ষার কোনো কলেজ বা ইউনিভার্সিটি নেই। ফলে তারা মিয়ানমারের অন্য কোনো কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাইলে অন্য দেশের নাগরিকের মতো নানারকম পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়। এতসব জটিলতা এবং নানারকম পরীক্ষায় পাস করার পরও রোহিঙ্গাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া হয় না। এই যখন অবস্থা, তখন সেনাবাহিনীর গুলিতে কিংবা নৌকা ডুবে নাফ নদীতে সলিল সমাধি অথবা আয়লানের মতো উপকূলে নিথর পড়ে থাকার বোধ হয় শ্রেয়। কারণ ‘জন্মই তাদের আজন্ম পাপ’।
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির কাছে দর্শকদের কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে যে, রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা হচ্ছে এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?’ প্রশ্নটি হেসে উড়িয়ে দেন সু চি। সেই হাস্যরসের ছবি আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। শুধু তাই নয়, সু চি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সঠিক খবর আসছে না বলেও অভিযোগ করেন এবং ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলের হৈ চৈ অসহ্য’ বলেও মন্তব্য করেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানের বদলে উল্টো এ নিয়ে আগের সামরিক সরকারের টোনেই কথা বলায় এরইমধ্যে সু চির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বানে স্বাক্ষর করেছেন লাখো মানুষ। কারো নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার এমন দাবি সম্ভবত এর আগে কারো ক্ষেত্রে ঘটেনি। সু চির জন্য এটি একটি বড় লজ্জার।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে মালয়েশিয়ার রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন হাজারো মানুষ। ৪ ডিসেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ ও র্যালিতে যোগ দেন খোদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা না বলতে মিয়ানমার আমাকে সতর্ক করেছিল। কিন্তু আমার কিছু যায় আসে না। কারণ রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতেই হবে। একই ধর্মবিশ্বাসের জন্য নয়, তারা মানুষ, তাদের জীবনের মূল্য আছে, এজন্য।
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকেই অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের জাতিসত্ত্বা এবং নাগরিকত্ব অস্বীকার করার পর থেকেই যখন তাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন শুরু হয়, তখন থেকেই প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকে তারা। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ কত মানুষকে জায়গা দেবে? সত্তর দশক থেকে আসা পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বলে ধারণা করা হয়। কেউ কেউ বলেন এই সংখ্যাটি আরও বেশি।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নানারকম অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত থাকার প্রমাণও রয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়া বা সৌদি আরবে গিয়ে তারা যখন অপরাধে জড়ায় তখন ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বাংলাদেশেরই। ফলে মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার যে দাবি নানা ফোরাম থেকেই তোলা হচ্ছে এমনকি বিএনপি ও জাতীয় পার্টিও এই ইস্যুতে সরকারকে নমনীয় হবার আহ্বান জানিয়েছে, তখন প্রশ্ন ওঠে,রোহিঙ্গা সংকটের দায় কার এবং বাংলাদেশের যদি এখানে কোনো দায় না থাকে, তাহলে এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে বাংলাদেশ কেন আশ্রয় দেবে?
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কি সেই স্তরে পৌঁছেছে যে একটা জাতিগোষ্ঠীর থাকা-খাওয়া-চিকিৎসা-পড়ালেখার ব্যবস্থা করবে? মিয়ানমারের প্রতিবেশী ভারত এবং তার সবচেয়ে বড় বন্ধু চীন কেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরব নয়? আবার মুসলমান বলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে যারা আশ্রয় দেয়ার যুক্তি দেখান, তারা কেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের কাছে এই অনুরোধ জানান না যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তারা নিয়ে যাক।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে শুরু থেকেই যে মানবিকতা দেখিয়েছে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত তার প্রশংসা করা। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকার পরও হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দিয়ে সরকারগুলো অবশ্যই মানবাধিকারের পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু সেইসাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ সীমান্ত একেবারে খুলে দিলে দলে দলে শরণার্থীরা ঢুকে পড়বে এবং তারপর যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা সামাল দেয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশের থাকবে না।
অনেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ানদের ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয় দেয়ার যুক্তি দেখান। মনে রাখা দরকার, সিরিয়া বা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের যে সংকট, সেটি বস্তুত পশ্চিমাদের স্বার্থ-সংঘাতের পরিণতি। আন্তর্জাতিক তেল আর অস্ত্র ব্যবসার শিকার সিরিয়ার শিশু আয়লান কুর্দি বা ওমর দাকনিশ। সুতরাং তাদের আশ্রয় দেয়ার দায় পশ্চিমাদেরই। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের দায় বাংলাদেশের নয়। এটি একেবারেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। মিয়ানমার সরকার চায় না সেখানে এই মুসলিম সংখ্যালঘুর থাকুক। তাহলে রোহিঙ্গারা সবাই ধর্মান্তরিত হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলে কি সংকটের সমাধান হবে? সে প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানা নেই।
তবে মানবিকতার কথা বলে বারবার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার যে কথা বলা হয়, সেটি শুনতে ভালো লাগে। রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে এসব কথা বলে বা জুমার নামাজের পর এই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা হয়তো খুশিও হন, কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। কারণ বাংলাদেশ যখন দলে দলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া শুরু করবে, তখন সেটি রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে মিয়ানমার সরকারকে উৎসাহিত করবে। সুতরাং এটি কোনো সমাধান নয়।
সমাধান একটাই, তা হলো আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ। চাপটা প্রথম আসতে হবে প্রতিবেশী ভারত ও চীনের কাছ থেকে। এরপর জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সার্ক, আরব লীগ, আশিয়ানের মতো দেশ ও সংগঠনগুলো যদি একযোগে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তারা যদি বলে যে দ্রুত রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা থামাও নইলে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে তাহলেই কেবল রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হতে পারে।
অর্থাৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে মানবাধিকারের কথা বলে আপাতত কোনো লাভ নেই। তার উপরে চাপ প্রয়োগই একমাত্র ওষুধ। এই ওষুধ প্রয়োগ করা না হলে নাফ নদীর উপকূলে শিশু আয়লানের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা শিশুর ছবি দেখে আমরা আহা উহু করব কিন্তু এই রাষ্ট্রহীন জাতির সামনে খোলা থাকবে কেবলই মৃত্যুর বিভীষিকা।
-লেখাটি চ্যানেল আই অনলাইন থেকে নেয়া।