নাসির নগর তান্ডব: রসরাজের পরিবার নিজ গ্রামে ফিরেছে
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি : ধর্ম অবমাননাকর সেই ছবিটি রসরাজ নিজে তার ফেসবুকে পোস্ট করেছিল কি-না সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বরং রসরাজের মতো একজন ‘অশিক্ষিত’ জেলের পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব নয় বলে একাধিক মন্ত্রীসহ অনেকেই প্রকাশ্যে বলেছেন। কিন্তু অভিযোগ উঠায় মামলা দায়েরের পর তিনি এখনও জেলহাজতে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় রসরাজের পরিবারের সদস্যরা এলাকায় ফিরে এসেছেন।
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু জাফর বলেন, ‘এলাকার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। পুলিশের পক্ষ থেকে অভয় দেওয়ার পর রসরাজের পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে নিজ গ্রাম হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবের এলাকায় ফিরে এসেছেন। সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে নাসিরনগরে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী দায়িত্ব পালন করছে।’
ঘটনার নেপথ্যে যারা তাদের ইতোমধ্যেই চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গ্রেফতারের জন্য পুলিশ কাজ করছে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন জানান, নাসিরনগরের ঘটনায় ইতোমধ্যে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে রসরাজ দাসের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট হয়নি। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফরেনসিক বিভাগ বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গত ২৮ নভেম্বর এ সংক্রান্ত মতামত দিয়েছে। তিনি আরও জানান, এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট এসেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, রসরাজ দাসের জব্দ করা মোবাইল ফোন থেকে ছবিটি পোস্ট করার আলামত পাওয়া যায়নি। তবে হরিপুর বাজারের আল-আমিন সাইবার ক্যাফে থেকে যেসব যন্ত্রাংশ জব্দ করা হয়েছে, সেগুলো থেকেও ছবি পোস্টের বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নয় পুলিশ।
সুপার মো. ইকবাল আরও বলেন, ‘ঘটনার পর আল-আমিন সাইবার ক্যাফে থেকে কিছু আলামত সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পরে ২৮ নভেম্বর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কালাইশ্রী পাড়া থেকে আল-আমিন সাইবার ক্যাফের মালিক জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৯ নভেম্বর তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শফিকুল ইসলামের আদালতে আনা হয়। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে ১০দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। পরে আদালত ৪দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন। প্রথম দফা রিমান্ডে জাহাঙ্গীর পুলিশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। তার দেওয়া তথ্য মতে, হরিণবের গ্রামে তার বন্ধু শিপনের বাড়িতে লুকিয়ে রাখা একটি কম্পিউটারের সিপিও উদ্ধার করা হয়। এই সিপিওটি পুলিশের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এই সিপিওটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ঘটনার মূল রহস্য পাওয়া যেতে পারে বলে পুলিশ ধারণা করছে।
পুলিশ জানায়, গত শুক্রবার জাহাঙ্গীরের প্রথম দফার চারদিনের রিমান্ড শেষ হয়। জাহাঙ্গীরের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকতে পারে বলে ধারণার প্রেক্ষিতে জাহাঙ্গীর আলমকে দ্বিতীয় দফায় আরও তিনদিনের রিমান্ডে আনা হয়। গতকাল শনিবার পুলিশ তাকে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে আনে। দ্বিতীয় দফায় শুরু হওয়া রিমান্ডে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার আশা করছে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ধর্ম অবমাননার প্রতিবাদের নামে ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর সদরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামের সংগঠন ও তৌহিদি জনতার ব্যানারে খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত সমাবেশের ডাক দেয়। ওই সমাবেশ থেকেই হামলার ঘটনা ঘটে। তবে ছবি পোস্টের সময় রসরাজ মাছ ধরতে বিলে ছিলেন বলে লোক মারফত জানা গেছে। এটা প্রমাণ হলে বোঝা যাবে রসরাজ এর সঙ্গে জড়িত নন।
এদিকে হামলার ঘটনার পর ইন্ধনদাতা হিসেবে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ও জনপ্রতিনিধিদের নাম উঠে আসে। হামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল হাসেম, চাপরতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. সুরুজ আলী ও হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. ফারুককে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। এছাড়া ঘটনার ইন্ধনদাতা হিসেবে হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখির নামও বিভিন্নভাবে আলোচনায় আসে। তবে এসব জনপ্রতিনিধি কারও বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মো: মিজানুর রহমান জানান, ঘটনার একমাস পার হওয়ার পর নেপথ্যের নায়ক অনেকেই পুলিশের জালে ধরা পড়েছে। অনেকে পুলিশের নজরদারীতে আছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
উল্লেখ্য, ৩০ অক্টোবর ধর্ম অবমাননার প্রতিবাদে হওয়া সমাবেশ থেকে নাসিরনগর সদরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। একই দিন হরিপুরে হিন্দুদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে সদরে মোট পাঁচ দফায় সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। পরে ৪ নভেম্বর পাঁচটি মন্দির ও বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এরপর ৫ নভেম্বর নাসিরনগর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেবের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।