অনর্গল কথা, ঢাকায় মমতাই যেন সুষমা
স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর পর্ব তখন শেষ। খোশ মেজাজে দুই প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। হঠাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন শেখ হাসিনা। বললেন,
মমতা -শেখ হাসিনা
‘‘তোমাকে ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না। থেকে যেতে হবে আজ, কোনও কথা শুনব না!’’
মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র ও নিজের প্রধান সচিব গৌতম সান্যালকে একটু আলাদা করে ডেকে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘কী করি বলুন তো! কাল সকালে কি ফেরা যায়?’’
তাঁরা বললেন, এমনিতে অসুবিধে ছিল না। কিন্তু রবিবার কলকাতা ফেরার উড়ান সেই সন্ধ্যায়। সকালে ফেরার কোনও উপায় নেই। কিছুটা ভাবলেন মমতা। তার পরে বললেন, ‘‘থাক! অনেক দেরি হয়ে যাবে। আজই ফিরে যাব।’’
হাসিনার কাছে গিয়ে হাত ধরলেন। বললেন— নিরুপায়, আজই ফিরতে হচ্ছে। এ বার হাসিনা বললেন, ‘‘তা হলে তো না-খাইয়ে ছাড়ছি না। তুমি ইলিশ পছন্দ করো আমি জানি। তিন রকম ইলিশ রাঁধিয়েছি। খেয়ে যেতে হবে।’’
চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান হল শাপলা হলে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সম্মানে হাসিনা নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন সোনারগাঁও হোটেলে। সেখানে নিরামিষাশী মোদীর জন্য একশো পদের ভোজ। খালাল ঢোকলা, ফ্রিল অব টোম্যাটো, ভেজ শাম্মি কাবাব, পটলের নিরামিষ দোলমা, পনির বাটার মশালা, ভিন্ডি কড়ি, বালালা বায়গন, ডাল তড়কা, হায়দরাবাদি ভেজ বিরিয়ানি, খিচ্ড়ি, রকমারি মিষ্টি, ফল, মিষ্টি দই।
তারই এক দিকে মমতার জন্য কিছু মাছের পদের আয়োজন। ইলিশ, ভেটকি, বাচা, কাচকির নানা পদ, রূপচাঁদা ভাজা।
কিন্তু বিমান ধরতে গেলে ভোজসভায় যাওয়া যায় না। কী করেন মমতা! বোধহয় তাঁর বেজার মুখ দেখেই হাসিনা বুঝে নিয়েছিলেন সমস্যাটা। বললেন, ‘‘অত ভাবনার কিছু নেই। তুমি খেয়েই যেয়ো। বিমান তোমাকে না-নিয়ে যাবে না। ওটা আমি দেখছি!’’ এক পার্শ্বচরকে ডেকে নিচু স্বরে কিছু বলে দিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। মমতার মুখেও হাসি ফুটল।
ভোজসভায় যেতেই হল মুখ্যমন্ত্রীকে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে। মোদীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন তাঁকে। হাসিনাকে বললেন, ‘‘এ আমার মন্ত্রী অরূপ।’’ অরূপকে বললেন, ‘‘পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কর!’’ সঙ্গে সঙ্গে ঢিপ করে প্রণাম করলেন অরূপ। মমতা অবশ্য খেলেন যৎসামান্য। স্যুপ আর একটু ঢোকলা। যেন কথা রাখতেই খাওয়া। শাড়ি বদলানোর সময়টুকুও পাননি। বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের এক নিঃশ্বাসে শুধু একটা কথাই বলতে পারলেন, ‘‘আজ ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। এতে সকলেরই উপকার হবে।’’
ইঞ্জিন চালু করে বিমান তখন মমতা ও তাঁর সঙ্গীদের অপেক্ষায়। তাঁরা উঠতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
বিকেলে মোদীর সঙ্গে বৈঠক, অথচ মমতার সঙ্গে বাংলায় অনর্গল কথা বলে চলেছেন হাসিনা। শুনছেন আর হাসছেন মোদী। একটি বাঙালি মেয়েকে অনুবাদক হিসেবে দিল্লি থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কখনও সেই কথাবার্তা হিন্দিতে তর্জমা করে দিচ্ছিলেন। ঘাড় নাড়ছিলেন মোদী। সুষমা স্বরাজ যাননি, ঢাকায় মমতাই যেন বিদেশমন্ত্রী। চুক্তি পর্ব মেটার পরে মমতাকে দেখিয়ে হাসিনাকে বললেন মোদী, ‘‘৮০ ভাগ কাজ কিন্তু উনিই করে দিয়েছেন!’’
মমতা দুপুরে মোদীর হোটেলে পৌঁছলে বিদেশসচিব সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর ও অতিরিক্ত সচিব ভাস্কর খুলবেকে মোদী বলেন, ‘‘আমরা আগে একটু ঘরোয়া ভাবে কথা বলে নিই?’’ সচিবরা বাইরে এসে অপেক্ষা করতে থাকেন। কথা ছিল মিনিট পনেরো কথা হবে, হলো প্রায় আধ ঘণ্টা। তার পরে গাড়িতে মমতাকে পাশে বসিয়ে হাসিনার দরবারে পৌঁছলেন প্রধানমন্ত্রী। কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর, অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসা এই প্রথম।
তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কোনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি কেন্দ্র। তাই হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সরকারি ভাবে তিস্তা প্রসঙ্গ তোলেননি মোদী। তবে আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে— তিস্তা নিয়ে খুব শীঘ্রই যে রাজনৈতিক সহমত তৈরি হবে, সে ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। মমতাও চান তিস্তা সঙ্কটের অবসান হোক।
এ দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দু’টি শাড়ি উপহার দিয়েছেন মমতা। একটি বালুচরী, অন্যটি কাঁথাস্টিচ। শুধু এটুকুই নয়। হাসিনাকে কলকাতা আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন মমতা। কথা প্রসঙ্গে মুজিব কন্যাকে জানালেন বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের জন্য রাজারহাটে জমির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলকাতার মোম মূর্তির প্রদর্শনীতে হাসিনার একটি মূর্তিও প্রস্তুত। তিনি এসে সবুজ সঙ্কেত দিলেই তা বসানো হয়ে যাবে। এ ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর নামে চেয়ারটির উদ্বোধনও যে করতে হবে হাসিনাকে। তাই না-এলেই নয়! হাসিনা শুনে হাসছিলেন। মোদী হাসিনাকে বললেন, ‘‘আপনি গোছগাছ শুরু করুন। আমি আপনার কলকাতা সফরের দায়িত্ব নিচ্ছি!’’
রাতে কলকাতা বিমানবন্দরে নামার পরেও মমতা বলছিলেন, ‘‘সত্যি। ও দেশের আন্তরিকতার কোনও তুলনা হয় না!’’
– আনন্দ বাজার