পুরো রাজ্যই কারাগার! রোহিঙ্গা অবশিষ্ট মাত্র দুই লাখ ৪০ হাজার
নিউজ ডেস্ক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর সেখানে মাত্র দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অবশিষ্ট আছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাজ্যটিকে রোহিঙ্গাদের জন্য কারাগারে পরিণত করেছে। সিএনএনের একটি ধারাবাহিক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই টেলিভিশন চ্যানেলের বেইজিং ব্যুরোর আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা ম্যাট রিভার্স গত মাসে রাখাইন রাজ্য সফর করে এসে এই বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এই প্রতিবেদনটি গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সম্প্রচার শুরু করেছে সিএনএন।
গত আগস্ট মাসে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দল রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ অধিনায়কদের বিচারের সুপারিশ করার পর ম্যাট রিভার্স রাখাইন রাজ্য সফর করেন।
মিয়ানমারের অভিবাসন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সিএনএন বলেছে, বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে নয় বরং অন্যত্র পুনর্বাসন করা হবে। তবে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে তাঁদের যে আলোচনা চলছে তাতে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের অভ্যর্থনাকেন্দ্রে রাখা হলেও পরে নিজ গ্রামেই পুনর্বাসনের কথা রয়েছে। মিয়ানমার এ পর্যন্ত প্রায় আট হাজার রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। এখন তাদের গ্রামওয়ারি তালিকা করা হচ্ছে। আগামী ২৮ বা ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে এ বিষয়ে আরো আলোচনা হবে।
গত বছর ২৪ আগস্ট গভীর রাতে রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পরদিন থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে পালিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশে। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় ৩০টি শিবিরে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সাত লাখ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৬ সালের অক্টোবরে এক দফা সেনা অভিযানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
গত বছর রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ ও উগ্রপন্থী লোকজন মিলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছিল। হত্যা করা হয় অন্তত ২৩ হাজার রোহিঙ্গাকে। আগুন দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ধর্ষণের শিকার হয় অন্তত ১৮ হাজার নারী।
সিএনএনের সংবাদদাতা ম্যাট রিভার্স বলেছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে যা দেখাতে চেয়েছিলেন এবং যেসব স্থানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাঁকে সেখানেই যেতে হয়েছে। এর ফাঁকেও তিনি ভয়াবহ চিত্র দেখতে পেয়েছেন। পরিত্যক্ত রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর ধ্বংসস্তূপ বর্ষায় গজিয়ে ওঠা লতাপাতায় আড়াল হলেও কিছু কিছু গাছে এখনো আগুনে পোড়া দাগ ও গুলির চিহ্ন আছে। সে দেশের কর্মকর্তারাও তাঁকে নিশ্চিত করেছেন যে রাখাইনে এখন প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা আছে।
রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা মিয়ানমার বাহিনীর সামনে সিএনএনের সংবাদদাতাকে বেশ ভালো থাকার কথা জানালেও আড়ালে বলেছে, এটি শেখানো কথা। তারা খুব ভয়ে আছে। শিক্ষা, চাকরি, চিকিৎসা, জীবন-জীবিকার সব সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুরো রাখাইন রাজ্য এখন তাদের কাছে একটি কারাগার।
সিএনএনের আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য দেখেছেন। গত আগস্ট মাসের প্রথমার্ধে রাখাইন রাজ্য সফরকালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলও প্রায় একই চিত্র দেখেছে। ওই প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য বলেছেন, তাঁরা রাখাইনে কাঁটাতারে ঘিরে রাখা একটি স্থান দেখতে পেয়েছেন। মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছেন সেখানে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে।
ম্যাট রিভার্স রাখাইনের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সেখানে কোনো গণহত্যা হয়েছে কি না? রাখাইনের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা গণহত্যার অভিযোগ পুরোপুরি নাকচ করেছেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, গণহত্যা হয়ে থাকলে রোহিঙ্গারা এখনো কিভাবে রাখাইনে আছে?
তবে সুনির্দিষ্টভাবে ইন দিন গ্রামে গণহত্যার এলাকাটিতে সিএনএনের সংবাদদাতাকে যেতে দেয়নি স্থানীয় লোকজন। তারা বলেছে, সেখানে গেলে নাকি অশুভ আত্মা উঠে আসবে।
সিএনএনের সংবাদদাতা বলেছেন, বিদেশি সাংবাদিক দেখে রাখাইন বৌদ্ধরা বিস্মিত হয়নি। যা থেকে তিনি ধারণা করেন যে তাঁর এই সফরের বিষয়ে আগে থেকেই তাদের বলা হয়েছিল।
নে ফু নামে এক রাখাইন বৌদ্ধ সিএনএনের কাছে রাজ্যে অশান্তির জন্য রোহিঙ্গাদেরই দায়ী করেন। রোহিঙ্গাদের ‘কালা’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, ‘কালারাই তাতমাদোকে (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) হুমকি দেওয়া শুরু করেছিল।’
আরেকজন দাবি করে, যা কিছু হয়েছে সব কালাদের জন্যই হয়েছে। রাখাইন বৌদ্ধরা তাদের ভয়ে কাঁদছিল। পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাতমাদোকে ভূমিকা রাখতে হয়েছে।
তবে মিয়ানমারের কর্মকর্তা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের ওই বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি। বরং জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনেও এসেছে, গত বছর আগস্টে রাখাইনে কথিত জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার বাহিনী অভিযান শুরুর বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের আরো প্রান্তিকীকরণের চেষ্টা চলছিল। তাদের জীবন-জীবিকার সুযোগ ও বাইরে থেকে খাদ্য সহায়তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
জাতিসংঘের তদন্তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য মিয়ানমার বাহিনী বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল। কালের কণ্ঠ