‘হারাদিন রিসকার চাকা ঘুরায়াও ভাগ্যের চাকা ঘুরেনা’
‘ফজর থেইক্যা মাগরিব পর্যন্ত রিসকার প্যাডেল ঘুরাই। হারাদিন রিসকার চাকা ঘুরাই,হেরপরও ঘোরেনা ভাগ্যের চাকা। দিনশ্যাষে ১ কেজি চাইল আর ২০০ গেরাম ডাইল হইলেই আলহামদুলিল্লাহ্।’
কথাগুলো বলেই আফসোসের দীর্ঘশ্বাস নয় যেন তৃপ্তির হাসি হাসলেন মো. লিটন (৪২)। পেশায় রিক্সাচালক। কিন্তু তিনি অন্যান্য সাধারণ রিক্সাচালকদের মতো নন। তিনি আলাদা। পেশায় রিক্সাচালক হলেও তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। অন্য কোনো অঙ্গ না থাকলেও হয়তো খুব বেশি অবাক হতাম না। অবাকই হলাম যখন দেখলাম হাঁটুর নিচ থেকে তার ডানপা-টিই নেই। এক পা নেই তবুও রিক্সাই চালান তিনি। না চালিয়েই বা উপায় কি? পা নেই বলে কেউই যে কাজে রাখতে চায় না তাকে।
মো. লিটনের বাড়ি রংপুরের হারাগাছি গ্রামে। স্ত্রী, একছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বস্তিতে থাকেন তিনি। ভাড়ার রিক্সা চালান ধানমণ্ডি এরিয়াতেই। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে রিক্সার মহাজনকে ১২০ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে কাঁচাবাজারের দিকে ছুটেন তিনি। তারপর আয় অনুযায়ী বাজার করে হাসিমুখে ফেরেন বাড়িতে। স্ত্রীর হাতে বাজার আর কিস্তির টাকা তুলে দিয়েই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন তিনি।
ছেলেটা তার নবম শ্রেনিতে (মানবিক) পড়ে আর মেয়েটা পঞ্চম শ্রেণিতে। ছেলেকে শিক্ষক আর মেয়েকে ডাক্তার বানানোর সপ্ন নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি। কথাগুলো বলতে বলতেই চোখ ছলছল করে উঠলো লিটনের। যেন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন মেয়েটা এপ্রোন পড়ে বেশি পান না খাওয়ার জন্য শাসাচ্ছে তাকে।
কিভাবে পা হারিয়েছেন জিজ্ঞাস করাতে এই প্রথম তিনি আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ৭ বছর বয়সে পায়ে পেরেক ঢুকেছিল। কয়েক মাস পর পায়ে গ্যাংরিন হয় তার। এরপর অবশ্য অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছিলেন রংপুরেই। কিন্তু বিধিবাম, লাভ হয়নি তাতে। আরোগ্য পেতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন। কিন্তু, ভাগ্যের লিখন। কি আর করা? শেষমেশ তার ঠিকানা হলো রংপুর মেডিকেল কলেজের বেডে। দায়িত্বরত চিকিৎসক জানালেন, বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। এখন আর পা না কেটে উপায় নেই। নইলে আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়বে সারাশরীরে। ছেলের জীবন বাঁচাতে পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্তে অশ্রুসিক্ত নয়নে রাজি হন তার বাপ-মা। সেখান থেকেই পা হারা তিনি।
এক পা নিয়ে রিক্সা চালাতে অসুবিধা হয় কিনা জিজ্ঞাসা করাতে লিটন জানায়, কষ্ট তো হয়ই। কিন্তু পেট তো চালাতে হবে। রিক্সা না চালালে খাবো কি? রিক্সা চালানোর চেয়েও তখন বেশি কষ্ট হয় যখন আমার এই অবস্থা দেখার পরও প্যাসেঞ্জার দ্রুত চালানোর জন্য তাগাদা দেয়। অনেক সময় পা নেই বলে অনেক প্যাসেঞ্জার আমাকে জিজ্ঞাসাও করেনা যাব কিনা। এমনকি আমি যদি জিজ্ঞাসাও করি কোথায় যাবেন, উত্তরও দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননা। অথচ আমাকে পার হয়ে পরবর্তী বিক্সাচালককে জিজ্ঞাসা করেন, যাবে কিনা। কষ্ট তখনই হয়।
‘কী পাইনি তারই হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’ রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তিটির মতোই এখন আর হিসাব মিলাতে চান না মো. লিটন। ছেলে-মেয়ে দুইটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে পারলেই দিনশেষে হিসাবের পাল্লাটা যে তার দিকেই ভারী হবে এটা বুঝেছেন অনেক আগেই। তাইতো তার মুখ বুজে এত্তো কষ্ট সহ্য করা। বিনা পরিশ্রমে একটা টাকাও কারো কাছ থেকে নিতে রাজি নন তিনি। সৎভাবেই কাঁটাতে চান জীবনের বাকি দিনগুলো। তাইতো এতো পরিশ্রম, এতো ত্যাগ। ভিক্ষা করলে হয়তো টাকার অভাব থাকতো না, কিন্তু অভাবের মধ্যে থাকলেও আত্নসম্মানবোধটা যে বড় প্রিয় লিটনের। তাই ওপথে হাঁটার চিন্তাও আনেননি কখনো মাথায়।
লিটনরাই খিদের জ্বালা রেখেও হাসতে, বাঁচতে, স্বপ্ন দেখতে, যুদ্ধ করতে, সৎ থাকার মন্ত্র জানে। আসুন না আমরাও জেনে নিই এই মন্ত্র।