মক্কা-মদিনার বাইরে যেসব সাহাবিদের কবর
ইসলাম ধর্মে সাহাবি শব্দ দ্বারা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথী বা সহচরদের নির্দেশ করে। এর বহুবচন শব্দ সাহাবা। ‘সাহাবি’ শব্দটি আরবী ভাষার ‘সুহবত’ শব্দের একটি রূপ। একবচনে ‘সাহেব’ ও ‘সাহাবি’ এবং বহুবচনে ‘সাহাব’ ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থ সংগী, সাথী, সহচর, এক সাথে জীবন যাপনকারী অথবা সাহচর্যে অবস্থানকারী। ইসলামী পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি দ্বারা রাসূলুল্লাহর সা. মহান সংগী-সাথীদের বুঝায়। ‘সাহেব’ শব্দটির বহুবচনের আরো কয়েকটি রূপ আছে। তবে রাসূলুল্লাহর সা. সংগী-সাথীদের বুঝানোর জন্য ‘সাহেব’-এর বহুবচনে ‘সাহাবা’ ছাড়া ‘আসহাব’ ও ‘সাহব’ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আল্লামা ইবনে হাজাররাহ. ‘আল–ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা’ গ্রন্থে সাহাবির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন: ইন্নাস সাহাবিয়্যা মান লাকিয়ান নাবিয়্যা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা মু’মিনান বিহি ওয়া মাতা আলাল ইসলাম’- অর্থাৎ সাহাবি সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি ঈমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।
উপরোক্ত সংজ্ঞায় সাহাবি হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
১. রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি ঈমান।
২. ঈমানের অবস্থায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ (আল-লিকা)।
৩. ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ (মাউত ’আলাল ইসলাম)।
বিদায় হজে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে প্রায় সোয়া লাখ সাহাবি হজব্রত পালন করেছেন। কিন্তু মক্কা-মদিনা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে অল্প সংখ্যক সাহাবিরই কবর খুঁজে পাওয়া যায়।
বিদায় হজে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে প্রায় সোয়া লাখ সাহাবি হজব্রত পালন করেছেন। কিন্তু মক্কা-মদিনা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে অল্প সংখ্যক সাহাবিরই কবর খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ বিদায় হজের বাণী মোতাবেক সাহাবিরা পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে। ফলে ওইসব দেশেই তাদের মৃত্যু হয়। আর এ কারণেই বহু সাহাবির কবর ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।
আজকের প্রতিবেদনে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সাহাবিদের কার কবর কোথায় তা জানব-
হজরত উকবা ইবনে নাফে (রা.) -এর কবর আলজেরিয়ায়।
হজরত আবুল বাকা আনসারী (রা.)-এর কবর তিউনিসে।
হজরত রুয়াইফা আনসারী (রা.)-এর কবর লিবিয়ায়।
হজরত আবদুর রহমান (রা.)-এর কবর উত্তর আফ্রিকায়
হজরত মাবাদ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কবর উত্তর আফ্রিকায়।
হজরত আবু রাফে (রা.)-এর কবর খোরাসানে।
হজরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রাহ.-এর কবর খোরাসানে।
হজরত আবু আইউব আনসারী (রা.)-এর কবর ইস্তাম্বুলে।
হজরত আবু তালহা আনসারী (রা.)-এর কবর বোহায়রা রোমে।
হজরত ফযল ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কবর সিরিয়ায়
হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর কবর হিমসে।
হজরত বিলাল হাবশী (রা.)-এর কবর দামেশকে।
হজরত আবুদ্দারদা (রা.)-এর কবর জর্ডানে।
হজরত জাফর ইবনে আবী তালিব (রা.)-এর কবর মোতায়।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রা.)-এর কবর জর্ডান নদীর পাশে।
হজরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-এর কবর জর্ডানের এক পাহাড়ে।
হজরত যিরার ইবনুল আযওয়ার (রা.)-এর কবর জর্ডানের এক পাহাড়ে।
হজরত উবাদা ইবনুছ ছামেত (রা.)-এর কবর জর্ডানের এক পাহাড়ে।
হজরত আবু যামআহ (রা.)-এর কবর তিউনিসে।
হজরত কুছাম ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কবর সমরকন্দে।
হজরত আমর ইবনে মাদিকরিব (রা.)-এর কবর নেহাওয়ান্দে।
৫০ হিজরিতে হজরত মুহাম্মদ ইবনে আবি সগরা (রা.) কাবুলের রাস্তা হয়ে পেশাওয়ার এবং পেশাওয়ার থেকে লাহোর হয়ে কেলাত পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। কেলাতের পাহাড়ে আজও সাতজন সাহাবি ও তাবেয়ির কবর আছে।
প্রসঙ্গত, সাহাবিদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তরভেদ থাকতে পারে, কিন্তু পরবর্তী যুগের কোন মুসলমানই, তা তিনি যত বড় জ্ঞানী, গুণী ও সাধক হোন না কেন কেউই একজন সাধারণ সাহাবির মর্যাদাও লাভ করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ্ এবং ইজমা একমত।
এই সাহাবিরাই আল্লাহর রাসূল সা. ও তাঁর উম্মাতের মধ্যে প্রথম মধ্যসূত্র। পরবর্তী উম্মাত আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআন, কুরআনের ব্যাখ্যা, আল্লাহর রাসূলের পরিচয়, তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, মোটকথা দ্বীনের সবকিছুই একমাত্র তাঁদেরই সূত্রে, তাঁদেরই মাধ্যমে জানতে পেরেছে। সুতরাং এই প্রথম সূত্র উপেক্ষা করলে, বাদ দিলে অথবা তাঁদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে দ্বীনের মূল ভিত্তিই ধসে পড়ে। কুরআন ও হাদীসের প্রতি অবিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে।
‘হাফেজ ইবন আবদিল বার’ সাহাবিদের মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন: রাসূলুল্লাহর সা. সুহবত ও তাঁর সুন্নাতের হিফাজত ও ইশায়াতের দুর্লভ মর্যাদা আল্লাহ তা’আলা এইসব মহান ব্যক্তির ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। এ কারণেই তাঁরা ‘খায়রুল কুরুন’ ও খায়রু উম্মাতিন’ এর মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন।
হাফেজ আবু বকর ইবন খতীব আল-বাগদাদী বলেন: ‘‘উল্লেখিত ভাব ও বিষয়ের হাদীস ও আখবারের সংখ্যা অনেক এবং সবই ‘নাসসুল কুরআনের’ ভাবের সাথে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ তাতে সাহাবিদের সুমহান মর্যাদা, আদালাত, পবিত্রতা ইত্যাদি ভাব ব্যক্ত হয়েছে। আল্লাহ ও রাসূল কর্তৃক তাদের আদালাতের ঘোষণা দানের পর পৃথিবীর আর কোন মানুষের সনদের মুখোপেক্ষী তাঁরা নন। আল্লাহ ও রাসূল সা. তাঁদের সম্পর্কে কোন ঘোষণা না দিলেও তাঁদের হিজরাত, জিহাদ, সাহায্য, আল্লাহর রাহে ধন-সম্পদ ব্যয়, পিতা ও সন্তানদের হত্যা, দ্বীনের ব্যাপারে উপদেশ, ঈমান ও ইয়াকীনের দৃঢ়তা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড এ কথা প্রমাণ করতো যে, আদালাত, বিশ্বাস, পবিত্রতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ন্যায়পরায়ণ ও পবিত্র ব্যক্তিই জন্মগ্রহণ করুন না কেন, তাঁরা ছিলেন সকলের থেকে উত্তম।’’
কোন কোন সাহাবির জীবদ্দশায় রাসূল সা. তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তবে মুসলিম পণ্ডিতদের অনেকে সাহাবিদের সকলেই জান্নাতি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে হাজার ‘আল–ইসাবা’ গ্রন্থে স্পেনের ইমাম ইবন হাযামের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেনঃ ‘আস-সাহাবাতু কুল্লুহুম মিন আহলিল জান্নাতী কাতআন- সাহাবিদের সকলেই নিশ্চিতভাবে জান্নাতী।’
রাসূল সা. তাঁর সাহাবিদের গালি দেওয়া বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে সমালোচনা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘আল্লাহ, আল্লাহ! আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করো না। তাদেরকে যারা ভালোবাসে, আমার মুহাব্বতের খাতিরেই তারা ভালোবাসে, আর যারা তাদেরকে হিংসা করে, আমার প্রতি হিংসার কারণেই তারা তা করে।’ তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।