বুধবার, ২৪শে অক্টোবর, ২০১৮ ইং ৯ই কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

আমি কেন যৌনপল্লীতে যেতে শুরু করলাম : এক পুরুষের খোলামেলা স্বীকারোক্তি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আধুনিক ভারতের ১০ জন পুরুষের জীবন নিয়ে বিবিসি-র হিন্দি বিভাগের বিশেষ প্রতিবেদনমালা ‘হিজ চয়েসে’-এর অংশ নীচের এই প্রতিবেদনটি। এই দশজনই সমাজ বা পরিবারের হাসি-মশকরা উপেক্ষা করে নিজের মতো করে জীবন কাটাচ্ছেন। অনেকের কাছে হয়তো তাঁদের এই জীবনধারা অপছন্দের, কিন্তু এঁরা সমাজের তৈরী করা কোনও নির্দিষ্ট জীবনধারায় নিজেদের আটকিয়ে রাখতে চান নি। এঁদের পরিচয় অবশ্য আমরা গোপন রাখছি।

ভারতের গুজরাট রাজ্যের ছোট একটি শহরের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার যাঁতাকলে পড়ে সময়মত বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি তার । চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছে এখন আর দশটা মানুষের মত জীবনকে আর ভাবছেন না তিনি। তার নিজের বয়ানে শুনুন সে কাহিনী :

সেই রাতটা এখনও মনে আছে – স্মরণীয় রাত ছিল সেটা।

২৮ বছরের জীবনে সেই প্রথমবার আমি কোনও নারীকে স্পর্শ করেছিলাম।

ওই নারী আমার স্ত্রী ছিলেন না। একজন যৌনকর্মী ছিলেন। আমার অবশ্য তাতে কোনও সমস্যা ছিল না, কারণ আমার ইচ্ছাগুলো তো পূরণ করতে পারছিলাম সেই মুহুর্তে।

পরের একটা গোটা সপ্তাহ ধরে আমি মনে মনে সেই মুহুর্তগুলো উপভোগ করেছিলাম।

মনে হচ্ছিল আমি যেন অন্য এক জগতে বাস করছি।

সত্যিই অন্য এক জগত।

তখনও আমার বিয়ে হয় নি। গুজরাতের যে শহরে আমি থাকি, সেখানে পুরুষের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা ছিল কম।

তাই আমার মতো অনেক যুবকেরই বিয়ে করার ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে উঠত না।

বিয়ে না হওয়ার যুক্তি হিসাবে আমার বাবা-মাকে নানা কথা শুনতে হত। কেউ বলত ‘আপনার ছেলে যদি সরকারী চাকরী করত, তাও না হয় কথা ছিল। বেসরকারী সংস্থার চাকরীতে কি কোনও ভরসা আছে? তারপর আপনাদের জমিজমাও নেই’ – এইসব কথা বলত।

সেই সময়ে আমার বেতন ছিল আট হাজার টাকা। আমি ছিলাম বাড়ির বড় ছেলে। আর আমারই বিয়ে হচ্ছিল না।

আমার মাথায় সব সময়ে একটা জিনিস ঘুরত, যে কোনও জায়গায় যদি একটা বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়ে যায়, তাহলে সমাজে আমি মুখ দেখাতে পারি।

এই রকম যখন আমার মানসিক অবস্থা, তখনই খুব কাছের বন্ধু নীরজের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।

ও আমার থেকেও কম রোজগার করত, তবুও ওর বিয়ের সম্বন্ধটা পাকা হয়ে গেল কারন ওর বাবার ২০ একর জমি ছিল।

আমরা চার বন্ধু মাঝে মাঝেই মদ খেতে পাশের একটা শহরে যেতাম।

পরিবারের কাছে আসামী
সেদিনও গিয়েছিলাম।বন্ধুরা বোধহয় আমার মন খারাপটা লক্ষ্য করেছিল। এক বন্ধু গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে বলেছিল, “তুই এত মন খারাপ করে আছিস কেন? চল আমার সঙ্গে। তুই যদি বিয়ে করেও নিস, তাহলেও এর মতো মজা পাবি না। দেখবি, দুনিয়াটা কত রঙীন। এঞ্জয় কর ভাই।”

আমার প্রথমে সায় ছিল না। বন্ধুরা পীড়াপীড়ি করতে লাগল। শেষমেশ ওদের সঙ্গে একটা হোটেলে গিয়েছিলাম আমি।

তার আগে আমি বেশ কয়েকবার ব্লু-ফিল্ম দেখেছি, কিন্তু কোনও নারী সংস্রব আমার কাছে সেই প্রথম।

তারপর থেকে ওই হোটেলে যাওয়াটা আমার অভ্যেসে পরিণত হলো।

পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত যেতাম ওই হোটেলে। নিজের মনকে শান্ত করার জন্য ওটা বেশ সহজ রাস্তা ছিল।

তবে একদিন আমার বাবার কানে কথাটা পৌঁছল কোনোভাবে।

আমার গায়ে তো হাত তুলতে পারেন নি, কিন্তু নিজের রাগটা আমার ওপরে প্রচন্ড চেঁচিয়ে প্রকাশ করছিলেন।

“তোমার লজ্জা করল না এটা করতে? নিজের মা- বোনের কথা একবারও ভাবলে না? সমাজে তারা মুখ দেখাবে কী করে সেটা ভাবলে না তুমি?” এইসব বলে চিৎকার করছিলেন বাবা।

মা আর দিদি কাঁদছিল। দিদির শ্বশুরবাড়িতেও এই ব্যাপারটা নাকি জানাজানি হয়ে গিয়েছিল।

আমি বলার চেষ্টা করেছিলাম যে বন্ধুরা মদ খাইয়ে আমাকে হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল। নেশার ঘোরে বুঝতে পারিনি কী করে ফেলেছি।

ক্ষমাও চেয়েছিলাম।

বাবা বলেছিল, “এতগুলো বছর ধরে একই ভুল করে গেলে – বারবার?”

এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে ছিল না।

বিয়ের চিন্তা এখন আর নেই তার।
তিনদিন কোনও কথা বলে নি বাবা। তৃতীয় দিনে সরাসরি বলল, “তোমার জন্য এক বিধবার সন্ধান পেয়েছি। তার পাঁচ বছরের একটা ছেলে আছে। কিন্তু মেয়েটি ভাল পরিবারের। মেয়ের বাবা তোমার এই সব কীর্তিকলাপ জানেন, তবুও বিয়ে দিতে রাজী হয়েছেন। তোমার বয়স বাড়ছে, এই সম্বন্ধটাতে আর না করোনা।”

ততদিনে আমার অন্য একজনকে পছন্দ হয়ে গেছে। যে হোটেলে আমি যেতাম যৌনকর্মীদের কাছে, মেয়েটি ওই হোটেলে কাজ করত। হাউসকীপিং বিভাগে কাজ করত ও – যারা হোটেলে ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে। রোজগার হয়তো বেশী করত না, কিন্তু তার হাসিটা ভীষণ সুন্দর ছিল।

কিন্তু আমার কীর্তিকলাপ ওর অপছন্দ ছিল। সে-ও আমাকে বিয়ে করতে রাজী হলো না।

আমি ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়লাম।

একটা না-পাওয়ার বেদনা আমার কুরে কুরে খাচ্ছিল। এমন একজন কাউকে না-পাওয়ার কষ্ট, যে জীবনভর আমার সঙ্গে থাকবে, আমার ভাবনাচিন্তাগুলো যার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারব। বিয়ে না করতে পারার কষ্টটা আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল ওই সময়ে।

আমার জন্য বাড়ির লোকজন সমাজে মুখ দেখাতে পারছিল না। তাই আমি একদিন বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলাম।

প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পরে বাবা-মার কথায় আমি বাড়ি ফিরেছিলাম।

তবে এসবের মধ্যেও আমার বিয়ে না হওয়া নিয়ে লোকে নানা কথা বলা বন্ধ করে নি। পরিবারের লোকজন সেসব শুনতে বাধ্য হত।

সমাজ ব্যাপারটাই আসলে এরকম – যেসব প্রশ্ন করলে মানুষের মনে দু:খ দেওয়া যায়, সমাজ সেই সব কথা বলতেই ভালবাসে।

কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা অসহ্য ঠেকছিল।

তাই চিরকালের মতো আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।

নতুন শহরে চলে এলাম আমি। নতুন লোকজন, নতুন এলাকা, কিন্তু আমার স্বভাব বদলালো না।

কখনও পড়শী নারী, কখনও বা পাশের কোনও শহরে চলে গিয়ে মনের ইচ্ছেগুলো মেটাতাম।

কোনও সময়ে আমার বসও আমার সঙ্গে যেতেন। আমার ওপরে খুব ভরসা করতেন উনি।

আজ আমার বয়স ৩৯।

বিয়ে হয় নি এখনও, কিন্তু এখন আমি আর একাকিত্বে ভুগি না।

বিয়ের যে স্বপ্ন আমি একটা সময়ে দেখতাম, সেগুলো সবই মিটিয়ে নিতে পারি আমি। হয়তো সেই সব স্বপ্নপূরণের সঙ্গী হিসাবে স্ত্রীকে পাই নি।

জীবনটাই এরকম।

এখন পরিবার সব কিছুই মেনে নিয়েছে। ছোটভাইও এক আদিবাসী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে।

আমি এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন।

বিয়ের চিন্তা এখন আমার মাথায় আর আসে না, কারণ আমি এখন যে জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তাতে আর বিয়ে করা মানায় না।

আমার বেতন এখন ৪০ হাজার টাকা, এছাড়াও কিছু উপরি পাওনাও হাতে আসে।

কোনও কিছুরই অভাব নেই, তাই মনে কোনও গ্লানিও নেই।

জানি না, যদি আমার বিয়ে হয়ে যেত, তাহলে জীবনটা কীভাবে কাটত!

তবে সমাজের পরোয়া করি না আজকাল আর।

আমি আমার স্বাধীন জীবন নিয়েই খুব খুশি। সূত্র- বিবিসি বাংলা