রিমান্ডে নিলেও ছেলেকে পাওয়া তো গেছে!
চার দিন লুকোচুরির পর অবশেষে ১২ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো। গতকাল সোমবার তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। শিক্ষার্থীদের পক্ষে আইনজীবীরা বলেন, আইন অমান্য করে তাঁদের পাঁচ দিন আটকে রেখে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার মহানগর হাকিম এই শিক্ষার্থীদের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের আদালতে উপস্থাপন করায় খুশি। গত রোববার ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিবারগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, পুলিশ তাঁদের সন্তানদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে লুকোচুরি করছে। তারা সত্যিই কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাঁদের যেন আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
গতকাল সন্ধ্যায় সিফাত বিন মানসুর ও সাইফুল্লাহ বিন মানসুরের বাবা মানসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইফুল্লাহকে কোর্টে তুলেছে। দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। তাতেও আমি খুশি। ছেলেকে পাওয়া তো গেছে!’
মানসুর রহমানের দাবি, ৫ সেপ্টেম্বর তেজকুনিপাড়ার ইউসুফ কুঠি থেকে তাঁর দুই ছেলে সিফাত ও সাইফুল্লাহকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) কার্যালয় থেকে সিফাত বেরিয়ে এলেও সাইফুল্লাহ ছাড়া পাননি। সাইফুল্লাহ একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছেন সম্প্রতি। ঢাকায় ১৫ দিনের প্রশিক্ষণে এসেছিলেন। করোটিয়ার সা’দত কলেজের শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ অনার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। এখনো ফল বেরোয়নি।
সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার্থী জহিরুল ইসলামের বাবা এনামুল হকও। খাগড়াছড়ির একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এনামুল হক বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমি অত্যন্ত খুশি। আমার ছেলেকে পাওয়া গেছে।’
তবে ডিবি তাঁদের কার্যালয়ে ১২ শিক্ষার্থীকে আটকে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। শনি ও রোববার এই শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়ে একাধিকবার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকাল সোমবার দুপুরে পুলিশ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। তেজকুনিপাড়ার ইউসুফ কুঠি থেকে ৫ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে চার দিন পর আদালতে পাঠানো এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন করতে পারে কি না, এমন প্রশ্ন করা হয় পুলিশকে। পরিবারের পক্ষ থেকে করা সংবাদ সম্মেলনেরও উল্লেখ করেন সাংবাদিকেরা।
জবাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘পরিবার দাবি করতেই পারে। কেউ অপরাধে জড়িত থাকলে গা ঢাকা দেন, আত্মগোপন করেন। পরিবার ব্রিফিং করেছে। কিন্তু তাঁরা তো কেউই পরিবারের সঙ্গে থাকতেন না। তাঁরা মেসে থাকতেন। গতকালই তাঁদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি এবং আজ আইনি বাধ্যবাধ্যকতা অনুযায়ী আদালতে পাঠিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, তাঁদের কাছ থেকে স্কুল ড্রেস, পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। অথচ তাঁরা ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নন। তাঁরা যে পোস্টগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিয়েছেন, সেগুলো তাঁদের অপরাধের প্রতিফলন। অপরাধ করার কারণেই তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।
যেসব অভিযোগ আনা হলো
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায়, গত রোববার রাত সাড়ে আটটায় তেজকুনিপাড়ায় অভিযান চালিয়ে ডিবি (উত্তর) ১২ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তাঁরা ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ার কথা পুলিশ আগেই বলেছে। তা ছাড়া স্কুলের পোশাক ও ভুয়া আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে কাউকে কাউকে রাস্তায় নামতে দেখা গেছে, এমন গোয়েন্দা তথ্যও ছিল। এই ১২ জন অনুপ্রবেশকারী। পুলিশ এঁদের কাছ থেকে ১৩টি পরিচয়পত্র, ১২টি স্কুল ড্রেস পেয়েছে। প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে পুলিশ জানতে পেরেছে, তাঁরা স্কুল-কলেজের ছাত্র নন। এ ছাড়া তাঁদের কাছ থেকে ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চারজন মারা গেছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে-এসব গুজব ছড়ানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে পুলিশ জানায়, ছাত্র আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিতে সবচেয়ে তৎপর ছিলেন তারেক আজিজ। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে আগেই তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে একটি মামলা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে বেশ কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। তাতে গ্রেপ্তার একজন শিক্ষার্থীকে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির ওপর কার্টুন আঁকতে দেখা যায়। ‘জিগাতলায় কী হয়েছে স্টুডেন্টের মুখ থেকে শুনুন’, ‘৪ জন মারা গেছে’, ‘৪ জন ধর্ষণ’, ‘শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির লাইসেন্স নাই’, ‘গাড়ি ভিতর মুড়ি’, ‘পুলিশ ঘুষ খায়’, ‘মন্ত্রী এমপি সবাই চোর’ ইত্যাদি লেখা ভিডিও ও পোস্টও দেখানো হয়।
ওই ১২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী স্লোগান দেওয়ারও অভিযোগ আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, ৬ আগস্ট দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা এলাকায় আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যলয়ের ৪০০ থেকে ৫০০ জন মিলে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্ররা নৌমন্ত্রী ও ‘সরকারবিরোধী বিভিন্ন উত্তেজনাকর স্লোগান’ দিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।
গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের সবাই শিবিরের কর্মী কি না, জানতে চাইলে ডিবি (উত্তর) উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, জাহাঙ্গীর আলম শিবিরের নেতা। ওয়ার্ডের সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদেরও আছেন। তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার্থী।
২ দিনের রিমান্ড
সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার ১২ ছাত্রকে আদালতে হাজির করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। অন্যদিকে জামিনের আবেদন করেন শিক্ষার্থীদের পক্ষের আইনজীবীরা। তাঁরা আদালতকে বলেন, এ মামলায় ১২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। এটি পুলিশের সাজানো মামলা।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নামে সরকারবিরোধী কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আসামিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুজব ছড়ানোর সুনির্দিষ্ট তথ্যও রয়েছে। আদালত ১২ শিক্ষার্থীর জামিন আবেদন নাকচ করে দুই দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নিন্দা
শিক্ষার্থীদের আটক করার পরও আদালতে হাজির না করার মতো অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর, বেআইনি ও স্পষ্টত মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এক বিবৃতিতে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় সহপাঠীদের মৃত্যুর ঘটনায় ন্যায়বিচার ও সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন আচরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সূত্র: প্রথম আলো