মিথ্যা গুজব ছড়ানোর ভয়াবহতা
আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে বাস করছি। প্রতিনিয়ত আমাদের হাতের মুঠোয় এসে পৌছাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খবর। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো বর্তমান সময়ে দুই ধরনের খবর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এক. বানোয়াট খবর দুই. মানুষের ভেতরে গুজব। মানুষের ঈমানের ফায়দা নিয়ে অনেকেই বানোয়াট কথা সমাজে ছড়িয়ে থাকেন।
কোনো রকমের হাদিস এবং কোরআনের দলিল ছাড়া রাসুল (স.) থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাহ্বীদের সামে ছড়ানো হচ্ছে বানোয়াট কথা। কথার শেষে আবার যোগ করে দেওয়া হচ্ছে যে ব্যক্তি এই খবর দশজনকে পৌঁছে দিবে তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম হয়ে যাবে! এই ধরনের ভিত্তিহীন কথা যোগ করে মানুষকে নানা ধরনের বানোয়াট খবর ছড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে বর্তমানে মিথ্যা শুধু কথার মাধ্যমেই ছড়ায় না। বরং বিভিন্ন ছবিকে নানা সফটওয়ারের দ্বারা পরিবর্তন করেও অনেক ধরনের মিথ্যা খবর ছাড়ানো হচ্ছে। যেমন- গরুর মাংসের টুকরোর মধ্যে আল্লাহ লেখা, শিশু জন্ম হয়েছে তারা শরীরের কোনো অঙ্গে আল্লাহ লেখা অবস্থায়। রাসুল (স.) এর জামা, চুল, জুতা ইত্যাদি নানা ধরনের কথা বলে এমন কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছাড়ানো হচ্ছে যার না কোনো প্রমাণ রয়েছে, না রয়েছে কোনো যুক্তি। আবার ছবিটির সাথে বিভিন্ন ধরনের হুমকিও দেওয়া হয়ে থাকে খাঁটি মুসলমান না হলে এই ছবিটি শেয়ার না করে যাবেন না। এই কাজগুলোকে আমরা কেউ কেউ বানোয়াট বলে চিহ্নিত করতে পারি। আবার কেউ কেউ সব সময় পারি না। কিন্তু এমন অনেক মানুষই আছেন যাদেরকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তারা বলবেন যে, দেখেন ভাই কথা মিথ্যা হলেও মূল বিষয়টি তো ভালো। রাসুল (স.) এর জামার ছবি নাও হয় কিন্তু সেই ছবি শেয়ার করলে তো আমার তার প্রতি মহব্বত বেড়ে যায়। গরুর মাংসের ভেতরে আসলে আল্লাহর নাম না লেখা থাকলেও এটা মানুষ দেখলে তারা হয়ত নামাজ পড়তে উদ্বুদ্ধ হবে। মূল কথা হচ্ছে, আমরা মিথ্যা কথা বলে থাকলেও শেষ পরিনতি হচ্ছে সমাজে ভালো কাজ ছাড়ানো। প্রশ্ন হলো আমাদের দিন কী এই ধরনের ভালো মিথ্যা কথা বলা অনুমোদন দিয়েছে?
প্রথমেই আমরা পবিত্র কোরআনের বক্তব্যে নজর দেই, ‘আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-ইসরা এ বলেছেন, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার পেছনে পড়ো না, নিশ্চই কান, চোখ ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’
সূরা হুজরাত এ ‘আল্লাহ তায়ালে বলেছেন, হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো খবর নিয়ে আসে তার সত্যতা যাচাই করে নাও, যাতে অজ্ঞাতবসত তোমরা কোনো মানুষের ক্ষতি না করে ফেল।’
অর্থাৎ কোরআন থেকে শিক্ষা নিলে আমরা বুঝতে পারি যে একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের অবশ্যই উচিত যেকোনো খবর সামনে পেলে তা যাচাই-বাছাই করে দেখা। কোরআনে ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে আলাদা করে মিথ্যা কথা বলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এর কারণ হলো আমাদের দ্বীন দৃঢ়ভাবে সত্যের উপর গঠিত। এই দ্বীনের আলো ছড়ানোর জন্য আমাদের কোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রায় নেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন পেজ থেকে বিভিন্ন ধরনের খবর এসে পৌছায়। কিন্তু এই পেজগুলো কারা চালাচ্ছে, কী উদ্দেশ্যে চালাচ্ছে এব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না এবং তাদের জ্ঞান সম্পর্কেও আমাদের কোনো ধারনা নেই। অতত্রব আমরা যে কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে আমাদের বিশ্বস্ত কোনো মানুষের কাছ থেকে সেই তথ্যের সত্যতা যাচাই করে তারপর সেটা অন্য জনকে জানাবো।
ওমর রা. তায়ালা আনহু বলেছিলেন, কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই নির্বিচারে বলে বেড়ায়।
তার এই কথাটি শুনলে মনে হয় যেন বর্তমান যুগের সামাজিক মাধ্যমের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই কথাটি বলা হয়েছে। আমরা নিউজ ফিডে একটির পর একটি খবর পড়তে থাকি এবং খুব সহজেই চিন্তা ভাবনা না করেই তা শেয়ার করে থাকি। শুধু ইসলাম নিয়েই ভিত্তিহীন কথা বলেই নয় আমাদেরকে ধোকা দেওয়া হচ্ছে আরও নানা ধরনের বানোয়াট গল্প দিয়ে বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে রটিত হচ্ছে কুৎসিত সব গুজব। রসালো এ গল্পগুলো এমনভাবে লেখা হয় যেন পাঠকেরা পড়ে মজা পায়। মজা পেয়ে তারা কোনো কিছু চিন্তা না করে গল্প গুলো ছড়িয়ে দেয়। মানুষের মধ্যে যদি রটানো গল্পগুলোর কিছু সত্যতা থেকেও থাকে, কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে এভাবে খবর ছাড়ানো ইসলামে মারাত্মক রকমের একটি পাপ। যাকে বলা হয় গীবত এবং যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
আরও : কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকে মারধর
বাস্তবে আমরা যদি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চাই তাহলে এ দিনকে বোঝার এবং এ ব্যাপারে সময় নিয়ে পড়া-শুনা করার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যখন কোরআনকে বোঝার চেষ্টা করব তখন দেখব এই কিতাব এত বেশি বিস্ময়কর যে এর ভাষা এত নিখুঁত এবং মনোমুগ্ধকর যে তখন আমাদের গরুর মাংসের টুকরোর মধ্যে অলৌকিক কিছু খুঁজতে হবে না। কোরআন এবং রাসূল (স.) এর সুন্নত-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট অলৌকিক হবে। এসব কিছু মাথায় রেখে আমাদের যা করা উচিত-
১. আমরা যে কোনো কিছু বলার আগে অথবা শেয়ার করার আগে আমাদের সাধ্যমত যাচাই করে নেব যে, কথাটি সত্য কি-না। কথা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় এবং আমরা যদি মনে করি এর দ্বারা মানুষেরা উপকৃত হবে তাহলে আমাদের এই কথাগুলোকে যাচাই করে দেখার জন্য একটু সময় দিতে কোনো সমস্যা থাকার কথা না। আমাদের মনে রাখতে হবে, বানোয়াট গল্প যে মূলত তৈরি করল তার পরিনতি তো ভয়ঙ্কর হবেই এবং যারা সেই গল্প ছড়াল তাদেরকেও হাশরের ময়দানে জবাবদীহি করতে হবে। অতএব কোনো কিছু যদি যাচাই করা সম্ভব না হয় তাহলে সে ব্যাপারে চুপ থাকাই শ্রেয়।
২. যে কোনো মানুষের ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নিয়ে গল্প ছড়িয়ে পড়লে সেটা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখুন। যে কোনো বিখ্যাত মানুষ হোক কিংবা অপরিচিত মানুষ হোক। কারো ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাই আমাদের জানার প্রয়োজন নেই। যদি এমন কোনো খবর পড়ে থাকেন যেখান থেকে শিক্ষণীয় কিছু আছে বলে আপনি মনে করেন তাহলে অবশ্যই সেই ঘটনার সত্যতা যাচাই করে তারপর সেই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ না করে এবং তাদের পরিচয় যাতে কোনো ভাবে সনাক্ত না করা যায় সেটা নিশ্চিত করে তারপরে সেই গল্পটি আপনি নসিয়তের উদ্দেশ্যে কারো সাথে শেয়ার করতে পারেন। তবে কোনো ভাবেই যেন এর মাধ্যমে কারো হক নষ্ট না হয় সেদিকে নজর দিকে হবে।
৩. আমরা যেন কোনোভাবে কোনো অবস্থাতেই ভুল করেও রাসূল (সা.) এর সম্পর্কে বানোয়াট তথ্য না ছড়াই। একজন সাধারণ ব্যক্তি সম্পর্কে বানোয়াট কথা বলাই গুরুতর অপরাধ কিন্তু রাসুল (স.) সম্পর্কে মিথ্যা বলা একটি অকল্পনীয় ভয়ঙ্কর রকমের পাপ। এবং এ ব্যাপারে স্বয়ং রাসুল (স.) আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন।
বুখারী হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল (স.) বলেছেন, আমার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলা অন্য কারো ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলার মতো না, যে ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ব্যাপারে মিথ্যা বলবে সে যেন জাহান্নামে তার জায়গা করে নেয়।
সত্য এবং মিথ্যার মিশ্রনে তৈরি অগণিত তথ্যের এই ডিজিটাল সমুদ্র যেন আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অজানা কোনো গন্তব্যে। এই পরিস্থিতিতে রাসূল (স.) এর একটি পরামর্শই হতে পারে আমাদের জন্য চূড়ান্ত দিক নির্দেশক। ‘যে আল্লাহ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস করে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’