এফডিসিতে মাদকের ব্যবসা!
নিউজ ডেস্ক : শুটিং না থাকলে সারা দিন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) ক্যানটিন আর এর আশপাশে তেমন লোকসমাগম দেখা যায় না। তবে সন্ধ্যা নামলেই এসব জায়গায় লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। ক্যানটিন থেকে কড়ইতলার দিকে যেতে যে দুটি গলি আছে, সেখানে কিছুটা অন্ধকার। মূলত এই দুই জায়গায় ভিড়টা একটু বেশিই থাকে। এ ছাড়া প্রশাসনিক ভবনের পেছনে সিঁড়ির জায়গায়, ঝরনা স্পট এবং ৩ ও ৪ নম্বর ফ্লোরের পেছনে সুইমিংপুলের কাছে সন্ধ্যার পর অপরিচিত ও বহিরাগত লোকের আনাগোনা চোখে পড়ে।
এরা মূলত সেখানে মাদক কেনাবেচা ও সেবন করে। পুলিশি ঝামেলা না থাকায় এফডিসি এলাকাকে ‘মাদক কেনাবেচার নিরাপদ স্থান’ মনে করে তারা। গত চার দিন সরেজমিনে ঘুরে, সন্ধ্যার পর যারা আসছে তাদের অনেকের সঙ্গে এবং এফডিসির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তবে এর পেছনে কারা আছে, তা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রয়েছে। এক পক্ষ বলছে, এফডিসির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মী এর সঙ্গে জড়িত। আবার কেউ বলছেন, কিছু সহকারী পরিচালক, অভিনেতা এর পেছনে আছেন। তাঁরা বাইরে থেকে নিজেদের পরিচিত বলে লোক এনে মাদক কেনাবেচার কাজ করেন।
এফডিসিকেন্দ্রিক এই মাদক কেনাবেচার বিষয় প্রায় সবার জানা। কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এমনটা চলে আসছে। এখন হয়তো এফডিসিতে কাজ কম হওয়ায় এবং মাদকসেবন বেড়ে যাওয়ায় বিষয়টি চোখে পড়ছে। গত শনিবার সকালে ঝরনা স্পটের সামনে একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন এ নিয়ে বলেন, ‘এটি অবাক হওয়ার মতো বিষয় না। এই অপরাধ তো নতুন কিছু না। বছরের পর বছর এটি হয়ে আসছে। আশির দশকে এই ঘটনায় তো আমি একজনকে বেদম পিটিয়েছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এফডিসি কর্তৃপক্ষকেই এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এফডিসিতে এখন আগের মতো সিনেমার শুটিং হয় না, বেশির ভাগ সময় টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শুটিং হয়। তাই এফডিসি অনেকটাই নিরিবিলি থাকে। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘লোকসমাগম থাকলে এ অবস্থা হতো না। আমাদের সময় প্রায়ই শুনতাম, যে শুটিং ফ্লোরগুলোর ছাদে ওঠা যেত, সেখানে দেদার মাদকসেবন চলে। এখন যেহেতু শুটিং খুব একটা নেই, পুরো এফডিসি নিরিবিলি, কষ্ট করে তাই ছাদে যাওয়ার দরকার হয় না। আনাচকানাচে এটা চলছে। এখানে দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা এ বিষয়কে মোটেও আমলে নেন না। এখানে নয়টা-পাঁচটা সরকারি যে নিয়ম, সেই সময় পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেন। ফলে সন্ধ্যার সময়টা এমন অপরাধ করার জন্য মোক্ষম সুযোগ হয়ে ওঠে।’
সম্প্রতি এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে যোগ দিয়েছেন আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘যাঁরা নিরাপত্তারা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলেছি। এফডিসিতে পুলিশি প্রহরা আছে। এমন ঘটনা যদি ঘটত, তাহলে শুনতাম। আমি এখন পর্যন্ত তেমন কিছু শুনিনি। আমার নজরে এলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফডিসির বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুইমিংপুল, ঝরনা স্পট, ক্যানটিনের সামনের জায়গা, কড়ইতলা ও প্রশাসনিক ভবনের পেছনে মাদক কেনাবেচার সবচেয়ে ভালো জায়গা। এফডিসির বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকলেও সব চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব অপকর্ম ঘটেই চলেছে। বিভিন্ন সময়ে এফডিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিল্পী, প্রযোজক ও পরিচালকদের সভায় মাদক বেচাকেনা ও সেবনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি।
এফডিসিতে মাদকের এমন দৌরাত্ম্যের কারণে শিল্পী, প্রযোজক ও পরিচালকের ওপর একটা দায় পড়ছে বলে মনে করছেন প্রযোজক-নেতা খোরশেদ আলম। গত রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এফডিসির বিভিন্ন কোনায় ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা সেবন চলছেই। সন্ধ্যা নামলেই এটা হচ্ছে। এফডিসি কর্তৃপক্ষকে অনেক বলার পরও কোনো পদক্ষেপ দেখিনি। এফডিসি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছে না যে তাদের ভাবমূর্তি কতটা নষ্ট হচ্ছে।’
প্রযোজক-নেতার এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এফডিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহকারী পরিচালক, কিছু পরিচালক এবং প্রোডাকশন বয় মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁদের মাধ্যমে অনেক তরুণ এফডিসিতে আসেন। কেউ এখানে মাদকসেবন করেন, কেউবা সঙ্গে করে নিয়ে যান।’
গত বুধবার দুই বন্ধুসহ এফডিসি ঘুরতে আসেন সাভারের ব্যবসায়ী এস এম বাশার। প্রধান ফটকের নিরাপত্তারক্ষীকে ২০০ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে তাঁরা ভেতরে ঢুকেছেন। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে ভেতরে শাকিব খান আর মৌসুমী শুটিং করছেন। কিন্তু ঢুকে দেখি এফডিসির কোথাও শাকিব-মৌসুমীর শুটিং নেই। ক্যানটিনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন বললেন, গাঁজা বা ইয়াবা লাগবে নাকি? এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাচ্ছি।’
চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম বলেন, ‘মাদকসেবন শুধু নয়, কিছু স্টোররুমে তো নিয়মিত জুয়া খেলা হয়। আমার ধারণা, এফডিসি কর্তৃপক্ষের কেউ এসবের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তা না হলে কেন কোনো শাস্তি হয় না, কেন এসব বন্ধ হচ্ছে না।’ চলচ্চিত্রের জ্যেষ্ঠ পরিচালক শাহ আলম কিরণ বলেন, ‘বিকেলের পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সরকারি এই প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। শুধু দারোয়ানের ওপর নির্ভর করতে হয়। এফডিসিতে গাঁজার গন্ধে টিকে থাকা মুশকিল। যে-কেউ চলার পথে এই গন্ধ পাবেন।’
এফডিসির পাশ ঘেঁষে গেছে রেললাইন। আর রেললাইনের পাশে রয়েছে বস্তি। এই রেললাইন ধরে হাঁটলে প্রায়ই গাঁজাসহ নানা মাদকদ্রব্য বিক্রির জন্য আহ্বান জানান অনেকে। এসব বস্তিতে প্রায়ই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানের খবর পাওয়া।
এফডিসি কর্তৃপক্ষ, চলচ্চিত্রের পরিচালক, প্রযোজক এবং নায়ক-নায়িকাদের ধারণা, কারওয়ান বাজার রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা বস্তিতে যাঁরা মাদকের ব্যবসা করছেন, তাঁদেরও এখানে হাত থাকতে পারে। অনেকেই আবার ক্যানটিনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এফডিসির এই ক্যানটিন চার বছর ধরে পরিচালনা করছেন কবির হোসেন রাজীব। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়ার জন্য তাঁকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘এই কথা আপনাকে কে বলেছে? আপনি আর কখনো আমাকে এই ধরনের ফালতু বিষয়ে ফোন করবেন না।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ঢাকা মেট্রোর উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘যেহেতু কারওয়ান বাজার রেললাইন এলাকার পাশে, তাই এফডিসি এই ধরনের অপরাধের জন্য নিরাপদ জায়গা মনে হতেই পারে। সরকারি স্থাপনা হওয়ার কারণে সেদিকে কম দৃষ্টি থাকে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এত দিন জানতাম না। এখন জেনেছি। এফডিসির মতো জায়গায় এমন অপরাধের সঙ্গে যারাই যুক্ত থাকুক না কেন, আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।’ প্রথম আলো