g বাকপ্রতিবন্ধী পরিবারের দু:খগাঁথা: বিজয়নগরের এক পরিবারের ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই কথা বলতে পারেন না | AmaderBrahmanbaria.Com – আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া

শনিবার, ১১ই নভেম্বর, ২০১৭ ইং ২৭শে কার্তিক, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

বাকপ্রতিবন্ধী পরিবারের দু:খগাঁথা: বিজয়নগরের এক পরিবারের ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই কথা বলতে পারেন না

AmaderBrahmanbaria.COM
অক্টোবর ২৯, ২০১৭
news-image

---

বিশেষ প্রতিনিধি : মাত্রই মুছে যাওয়ার ছাপ বাড়ির উঠানে। কানে ভেসে আসে সেলাই মেশিনের খুঁটখাট শব্দ। নারিকেলের গায়ে দায়ের আঁচড় লাগার শব্দ। খাবার পেয়ে শব্দ করে যেন খুশির জানান দিচ্ছে হাঁস-মুরগিগুলো! সাত সকালে এমনই এক পরিবেশ রঞ্জিত চন্দ্র সরকারের বাড়িতে।

বুধবার সকালে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির সবাই কর্মব্যস্ত। রঞ্জিত সরকার নারিকেল থেকে ছোবা সরাচ্ছিলেন। তাঁর মেয়ে ববিতা সরকার আপন মনে সেলাইয়ের কাজ করে যাচ্ছেন। আরো দুই সন্তান ব্যস্ত হাঁস-মুরগির খাবার দিতে। এক সন্তান চলে গেছেন নিত্যদিনকার কাজে। রঞ্জিত সরকারের স্ত্রী অরুণা সরকার উঠান মুছার কাজ করছেন।

তবে কারো মুখে কোনো ‘রা’ নেই। বাড়িতে আসা আগন্তুকের দিকে যেন সবাই ফেল ফেল করে তাকিয়ে। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না। আগে থেকেই জানা যে, এ বাড়ির ছয় সদস্যের পাঁচজনই কথা বলতে পারেন না। তবে যে জন কথা বলতে পারেন তাঁর মুখেও যেন ইচ্ছে করেই কুলুপ আঁটা। কথা বলেই বা লাভ কি? কেউ তো আর কথা শুনেনা! কম কথা বলাতেই তিনি এখন অভ্যস্ত।

বিজয়নগর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে বাকপ্রতিবন্ধী এ পরিবারটির বসবাস। রঞ্জিত চন্দ্র সরকার নিজেসহ তার পরিবারের মোট পাঁচ সদস্য বাকপ্রতিবন্ধী। এ কারণে পরিবারটির কষ্টের শেষ নেই। আর্থিক অনটন থেকে শুরু করে নানা ধরণের সমস্যা লেগেই আছে পরিবারটিতে। এ পরিবারে কথা বলতে পারেন শুধু রঞ্জিত সরকারের স্ত্রী।

স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জন্ম থেকে বাকপ্রতিবন্ধী রঞ্জিত চন্দ্র সরকার। বছর বিশেক আগে বিয়ে করেন নাসিরনগরের অরুণা সরকারকে। রঞ্জিত-অরুণা দম্পত্তির চার সন্তান। বিপুল সরকার, ববিতা সরকার, শিমুল সরকার ও কবিতা সরকার নামে চার সন্তানই বাবার মতোই জন্ম থেকে বাকপ্রতিবন্ধী।
রঞ্জিত সরকার কৃষি ও গৃহস্থালির কাজ করেন। দুই ছেলে বিপুল ও শিমুল কাঠমিস্ত্রীর কাজ শিখছে। বড় মেয়ে ববিতা সেলাইয়ের কাজ জানে। সবার ছোট মেয়ে কবিতা সাংসারিক বিভিন্ন কাজে সঙ্গ দেয়। রঞ্জিত সরকারের বাবা-মা ইতিমধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন। ছোট ভাই সরকারি চাকুরে পন্ডিত চন্দ্র সরকার ও তাঁর স্ত্রী থাকেন একই বাড়িতে। তাঁরা অবশ্য কথা বলতে পারেন।

অরুণা সরকার ও পন্ডিত সরকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রঞ্জিত সরকারের পরিবারের পাঁচ সদস্য বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ায় তাঁরা বেশ বিপাকে আছেন। কানে শুনেন না বলে তাঁদেরকে সহজেই কিছু বুঝানো যায় না। কোনো কাজ দিলে সঙ্গে একজনকে থাকতে হয়।

বিভিন্ন উদাহরণ টেনে তাঁরা জানান, প্রায়ই এমন হয়েছে যে রঞ্জিত সরকারকে কিছু একটা বিক্রির জন্য বাজারে পাঠানোর সময় ইশারায় যে দাম বলে দেয়া হয় এর কিছু কম দাম উঠলেও জিনিসটি বিক্রি না করে বাড়ি নিয়ে আসেন। জমিতে সেচের পানি দেয়ার কাজে পাঠানো হলে দেখা যায়, পুরো দিনই সেখানে কাটিয়ে দিয়েছেন। কেননা, অন্যরা এসে ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে তাঁকে বসিয়ে রেখে নিজের জমিতে পানি দিয়ে ফেলেন। কোথাও বেরিয়ে পড়লে তাদেরকে খোঁজে বের করে আনা মুশকিল হয়ে পড়ে।

অরুণা সরকার জানান, সব কিছু জেনে শুনেই রঞ্জিত সরকারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। রঞ্জিত সরকার কথা বলতে ও বুঝতে পারতেন না বলে বিয়ের পর পর বেশ সমস্যা হয়। তবে শশুর-শাশুরি তা কাটিয়ে তুলতেন। সংসার বড় হওয়ার পর এখন ভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। কেননা, রঞ্জিত সরকারের তেমন কোনো আয় না থাকায় আর্থিক টানাপোড়েন লেগেই থাকে। দুই ছেলে সবেমাত্র কাঠের কাজ শিখছেন। তাও নিয়মিত যেতে চায় না। বড় মেয়ে ববিতা সেলাইয়ের কাজ করে যে আয় করেন তা খুবই নগণ্য। তবে দেবর পন্ডিত সরকার তাঁদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন।

অরুণা সরকার বলেন, ‘বিয়ের বয়স হওয়া বড় মেয়ের ভাগ্যে কি আছে জানি না। কোনো পাত্রের সন্ধান পাচ্ছি না। বিয়ে দিতে পারবো কি-না জানিনা। ওই মেয়েটাকে ঘরে একা ফেলে কোথাও যেতেও পারি না। দেবর পন্ডিত পাশের উপজেলায় (আখাউড়া) চাকরি করেন বলে বাড়িতে খুব একটা সময় দিতে পারেন না। যে কারণে সব সময় আমাকে একটা বাড়তি টেনশনের মধ্যে থাকতে হয়। সব মিলিয়ে খুব সমস্যায় আছি।’

পন্ডিত সরকার বলেন, ‘আমাদের এলাকাতে এমন একাধিক পরিবার আছে যে সেখানে বাবা বাকপ্রতিবন্ধী হলেও সন্তানেরা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ভাইয়ের বেলায় কেন এমন হলো বুঝতে পারছি না। চারসন্তানই বাকপ্রতিবন্ধী হওয়ায় নানা ধরণের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়।’ পরিবারের পাঁচ সদস্য সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা পান বলে জানান তিনি।

এ জাতীয় আরও খবর