কোচিং বাণিজ্যে ৮ বিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক চিহ্নিত
---
রাজধানীর নামিদামি ৮ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ইতিমধ্যে ওই সব শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে অভিযান পরিচালনা ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছে দুদকের অনুসন্ধান দল। তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ শেষে অনুসন্ধান দল তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিশনের কাছে সুপারিশ করবে ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ, মতিঝিল মডেল স্কুল, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ধানমণ্ডি সরকারি বালক স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, কোচিং বাণিজ্যের অন্তর্বর্তীকালীন অনুসন্ধান প্রতিবেদন পেশ করার পর কমিশন প্রতিবেদনটি খতিয়ে দেখে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়। এরপরই ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়-১-এর উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের টিম গঠন করে অনুসন্ধান কাজ শুরু হয়। এই টিমে রয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, আবদুল ওয়াদুদ, মনিরুল ইসলাম, ফজলুল বারী ও উপসহকারী পরিচালক আতাউর রহমান।
অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত রাজধানীর নামিদামি ৮ স্কুল এন্ড কলেজের শতাধিক শিক্ষককে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট বিকেলে দুদকের ১০ সদস্যের একটি টিম রাজধানীর মতিঝিল, সিদ্ধেশ্বরী ও শাহজাহানপুর এলাকায় কোচিং সেন্টার বা বাসা ভাড়া করে প্রাইভেট পড়ানোর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। অভিযানে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে কোচিং সেন্টারে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদান অবস্থায় পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে দুদক সূত্র জানায়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজির শিক্ষক নিজাম কামালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি শাহজাহানপুরে একটি ছয় তলা ভবনের চার তলা পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে কোচিং ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। দুদকের অভিযানে এ বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানকাজে অসহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযানের সময় ওই কোচিং সেন্টারেই পাওয়া যায় শিক্ষক নিজাম কামালকে। এসময় তিনি ভবনের একটি কক্ষের দরজা বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান করেন। অনেক অনুরোধেও দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। অভিযানে ওই একই স্কুলের বাংলার শিক্ষক আফজাল গনী ও গনিতের শিক্ষক আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে কোচিং ব্যবসার সত্যতা পায় দুদকের অনুসন্ধান দল। তাদের প্রত্যেকের কোচিং সেন্টারে কমপক্ষে অর্ধশত ও শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি পাওয়া যায়। এছাড়া আরো কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিকভাবে প্রাইভেট পাড়ানোর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও তারা পেছন দড়জা দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
সূত্র জানায়, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদক টিম। দুদকের টিম প্রাথমিকভাবে তাদেরকে মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা ভঙ্গ করায় সতর্ক করে দেয়। সতর্ক করার পরও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে যারা কোচিং বাণিজ্যে লিপ্ত থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে দুদক।
এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান এবং সংস্থার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যেসব শিক্ষক অবৈধভাবে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত আছেন তাদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। উক্ত তালিকার তথ্য যাচাই বাছাই শেষে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শেষে অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে পাঠানো হবে। কমিশন এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেবে।’
২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগ আছে, এই নীতিমালা উপেক্ষা করে এখনো চলছে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য।
ওই নীতিমালায় নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং অথবা প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিজ বাসায় পড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে লিখিতভাবে ছাত্র-ছাত্রীর নাম ও রোল নম্বরসহ তালিকা জানাতে হবে। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা ওই ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজনকে পড়ালেও তাকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। এমনকি কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা কোচিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হতে পারবেন না।
শাস্তির বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে সাময়িক বা চূড়ান্ত বরখাস্ত, এমপিওভুক্ত শিক্ষক হলে এমপিও স্থাগিত, বাতিল, বেতন ভাতাদি স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ইদানিং গণমাধ্যমে কোচিং বাণিজ্যের বেশকিছু খবর প্রকাশিত হয়। অভিযোগ রয়েছে স্কুলের শিক্ষকরা পাঠদানের সময় বাইরে গিয়ে কোচিং সেন্টারে পড়ান। এমনকি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য করেন। যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত নীতিমালা বহির্ভূত।’
তিনি বলেন, ‘এ সংক্রান্ত অভিযোগ পাওয়ার পর দুদক থেকে ৫ সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। টিম প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকের একটি তালিকা করে। সেই তালিকা অনুসারে দুদকের ওই টিম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। দুদক টিমের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিশন আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ, দুদক অবৈধ কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
এর আগে চলতি বছর দুদক রাজধানীর ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। এর কিছুদিন পর কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। গোপনে অনুসন্ধান চালিয়ে কিছু সংখ্যক কোচিং সেন্টারের নাম, সেখানকার শিক্ষক, শিক্ষকদের স্কুল বা কলেজ, আয়-ব্যয়, নামে-বেনামে সম্পদ, সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের নাম ও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘যারা সরকারি শিক্ষক এবং যারা এমপিওভুক্ত, তারা ক্লাসে শিক্ষাদান করবেন এটাই নিয়ম। সরকারি অনুমোদন ছাড়া এর বাইরে যদি তারা কিছু (কোচিং) করেন, সেটা আমরা দুর্নীতির মধ্যেই ফেলবো। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোচিং বাণিজ্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।’