সর্বকালের সেরা প্রত্যাবর্তন কি এটিই?
স্পোর্টস ডেস্ক : ন্যু ক্যাম্পে কাল কী দারুণ এক প্রত্যাবর্তনের উপাখ্যান লিখল বার্সেলোনা! ভালোবাসা দিবসে প্যারিসে ৪-০ গোলে হেরে যাওয়ার পর চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটে যেতে হলে বার্সাকে ফিরতি লেগে অলৌকিক কিছুই করতে হতো। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে নেইমার-জাদুতে পিএসজিকে ৬-১ গোলে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটে পৌঁছে গেছে বার্সা। ক্লাব ফুটবলে এটি কি ঘুরে দাঁড়ানোর ‘শ্রেষ্ঠতম’ উদাহরণ?
রিও ফার্ডিনান্ড এটিকেই ‘সেরা’ বলেই রায় দিয়েছেন। সাবেক এ ইংলিশ ফুটবলারের সঙ্গে অনেকেই একমত—২০০৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে লিভারপুলের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পকেও ছাড়িয়ে গেছে বার্সা। অবশ্য এটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে রূপকথার গল্প অতীতে যেমন হয়েছে সামনেও নিশ্চয়ই হবে। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে অসাধারণ কিছু ফিরে আসার গল্প এখানে—
বার্সেলোনা-পিএসজি, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস লিগ
৩ মিনিটে লুইস সুয়ারেজের গোলে বার্সার এগিয়ে যাওয়া। ৪০ মিনিটে ইনিয়েস্তার ব্যাক হিল থেকে কুরজাওয়ার আত্মঘাতী গোলে সেটি হয়ে গেল ২-০। ৫০ মিনিটে লিওনেল মেসি স্কোরলাইন ৩-০ করলেন নেইমারের আদায় করা পেনাল্টি থেকে। ৬১ মিনিট পর্যন্ত ৩-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরও ম্যাচের ‘ক্লাইম্যাক্স’ ৬২ মিনিটে—পিএসজি ম্যাচে ফেরে এডিসন কাভানির গোলে। কিন্তু ‘অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স’ তখনো বাকি। বাকি চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে ঘুরে দাঁড়ানোর দুর্দান্ত গল্পটা রচিত হওয়ার। ৮৭ মিনিট পর্যন্ত বার্সার তিন গোলের ঘাটতি। ঠিক এরপরই ন্যু ক্যাম্পের সব আলো নিজের দিকে টেনে নিলেন নেইমার। ৮৮ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে গোল করলেন। যোগ করা সময়ের শুরুতে পেনাল্টি থেকে আবার গোল! ৯৫ মিনিটে নেইমারেরই দুর্দান্ত ফ্রি কিকে নিখুঁত ফ্লিক করলেন সার্জি রবার্তো! দুই লেগ মিলিয়ে ৬-৫ ব্যবধানে পিএসজিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সা। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
লিভারপুল-এসি মিলান, ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগ
১২ বছর আগে ইস্তাম্বুলে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালটি অনেকের চোখে এই প্রতিযোগিতার ইতিহাসের সেরা ফাইনাল। মালদিনি-কাকা-শেভচেঙ্কোদের এসি মিলানের কাছে ম্যাচের ৪৪ মিনিটেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল লিভারপুল। শিরোপার আশা ওখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্টিভেন জেরার্ডে অনুপ্রাণিত লিভারপুল হার মানেনি। ৫৪ থেকে ৬০—ছয় মিনিটের ঝড়ে ৩ গোল করে ম্যাচে সমতা নিয়ে আসে তারা। মহানাটকীয় ফাইনালের শেষ হলো টাইব্রেকারে, যাতে ৩-২ ব্যবধানে জিতে জয়োৎসব করল লিভারপুল।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-বায়ার্ন মিউনিখ, ১৯৯৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ
ট্রফিটিতে বায়ার্ন মিউনিখের নাম প্রায় লেখা হয়েই গিয়েছিল। ন্যু ক্যাম্পে ৯০ মিনিট শেষ, তখনো প্রথমার্ধের ৫ মিনিটে মারিও ডেসলারের ফ্রি-কিকে এগিয়ে বায়ার্ন। কিন্তু অতিরিক্ত তিন মিনিটে ডেভিড বেকহামের দুটি কর্নারে দুই বদলি খেলোয়াড়ের গোলে গেল সব উল্টে! ৯১ মিনিটে টেডি শেরিংহাম, ২ মিনিট পর ‘স্মাইলিং অ্যাসাসিন’ ওলে গানার সোলসকায়েরের গোল! রূপকথায় অভিভূত ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যাচ শেষের প্রতিক্রিয়াও চমকে দেওয়ার মতো, ‘ফুটবল, ব্লাডি হেল!’
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-জুভেন্টাস, ১৯৯৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ
বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে ন্যু ক্যাম্পের ফাইনালের এক ম্যাচ আগেই একটি দুর্দান্ত গল্প লিখে রেখেছিল ইউনাইটেড। ম্যানচেস্টারে প্রথম লেগে ১-১ সমতা। জুভেন্টাসের মাঠে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ১১ মিনিটের মধ্যেই ফিলিপো ইনজাগির ২ গোল, জুভেন্টাসই ফাইনালে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু অ্যালেক্স ফার্গুসনের শিষ্যরা হার মানলে তো! প্রত্যাবর্তনের শুরুটা করেন অধিনায়ক রয় কিন, এরপর ডুইট ইয়র্কের গোলে সমতা। কাজটা শেষ করেন অ্যান্ডি কোল, ৩-২ গোলে ম্যাচ জেতে ইউনাইটেড। তখন কে ভেবেছিল, এর চেয়েও অবিশ্বাস্য গল্প লেখা হবে পরের ম্যাচেই!
রিয়াল মাদ্রিদ-মোনাকো, ২০০৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ
মাদ্রিদে কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে ৪-২ গোলের হার। ঘরের মাঠে দ্বিতীয় লেগে জিদান-ফিগো-রাউল-রোনালদোদের বিপক্ষে এই বাধা পেরোনো মোনাকোর জন্য কঠিনই ছিল। কঠিন কাজটাকে ম্যাচের ৩৬ মিনিটে প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন রাউল, দুই লেগ মিলিয়ে রিয়াল তখন ৫-২ গোলে এগিয়ে। কিন্তু মোনাকো অধিনায়ক লুডোভিক জুলির জোড়া গোল আর ওই মৌসুমেই রিয়াল থেকে ধারে আসা ফার্নান্দো মরিয়েন্তেসের গোলে অসম্ভবকেও সম্ভব করল মোনাকো। দুই লেগে ৫-৫ সমতা, অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে সেমিফাইনালে গেল ফ্রেঞ্চ ক্লাবটি।
বার্সেলোনা-মেটজ, ১৯৮৪ ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ
ম্যাচটার বর্ণনায় উয়েফার ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছিল, ‘দুটি সিট্রোয়েন সিভি হারিয়ে দিল ফেরারিকে!’ বার্সার খেলোয়াড়েরা যেখানে ফেরারিতে চড়তেন, মেটজের ভাগ্যে ছিল শুধু দুটি সিট্রোয়েন সিভি ও একটি রেনল্ট-৮ গাড়ি! শেষ ৩২-এর প্রথম লেগে ঘরের মাঠে বার্সেলোনার কাছে ৪-২ গোলে হেরেছিল মেটজ। অবস্থা এমন ছিল যে, ফ্রেঞ্চ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দ্বিতীয় লেগটি সম্প্রচারই করেনি। শুধু পত্রিকার একজন সাংবাদিক ও রেডিওর এক উপস্থাপক ন্যু ক্যাম্পে যান ম্যাচটা কাভার করতে। দ্বিতীয় লেগেও প্রথমে গোল করে বার্সা। কিন্তু টনি কুরবোসের হ্যাটট্রিক ও সানচেজ ফিলিপসের আত্মঘাতী গোলে বার্সেলোনাকে চমকে দিয়ে দুই লেগ মিলিয়ে মেটজ জেতে ৬-৫ গোলে।
মিডলসবরো-স্টুয়া বুখারেস্ট, ২০০৬ উয়েফা কাপ
সেমিফাইনালের প্রথম লেগে রোমানিয়ায় গিয়ে ১-০ গোলে হেরেছিল মিডলসবরো। ঘরের মাঠে দ্বিতীয় লেগেও স্টুয়া বুখারেস্টের কাছে ২৪ মিনিটে ২ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল। জিততে হলে ৪ গোল করতে হবে, ২৬ মিনিটে স্বাগতিক কোচ নামিয়ে দেন স্ট্রাইকার মাসিমো ম্যাকারোনেকে। ৩৩ মিনিটে প্রথম ও ৮৯ মিনিটে মিডলসবরোর ভাগ্য গড়ে দেওয়া গোলটি করেন ইতালিয়ান স্ট্রাইকার। মাঝে মার্ক ভিদুকা ও ক্রিস রিগটের গোল দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৩ গোলে জিতিয়ে ফাইনালে তোলে ইংলিশ ক্লাবটিকে। টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালেও এফসি বাসেলের সঙ্গে দ্বিতীয় লেগে ৪ গোল করে জিততে হয়েছিল মিডলসবরোকে, ৯০ মিনিটে শেষ গোলটি করেছিলেন ম্যাকারোনে। সূত্র: উয়েফাডটকম।