হুমায়ূনের অয়োময় নাটকের খড়ম জোড়াটি তৈরী করেছিল বাঞ্ছারামপুরের আবদুল মিয়া
---
সালমা আহমেদ.বাঞ্ছারামপুর : অয়োময় ধারাবাহিক নাটকটির কথা মনে আছে ? নাটকের প্রধান চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর এমপি মির্জা সাহেব দারুন অভিনয় সকল মহলে সমাদৃত।তো,অয়োময় নাটকের সেই মির্জা সাহেব জমিদারী দেখাশুনা করতে যখন এলাকা পরিদর্শনে বের হতেন,পায়ে থাকতো বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরী খড়ম জুতো।বাঙ্গালী সংস্কৃতির এক কালে গ্রামের সাহেব-সর্দার কিংবা বিত্তবানদেও পায়ে জুটতো বর্তমানে যা একেবারেই প্রায় বিরল,এই খড়ম।অয়োময় নাটকের আসাদুজ্জামান নূরের পায়ে যে খড়ম জুতো শোভা পেতো,সেটির প্রস্তুতকারন ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সোনারামপুর পূর্বহাটির মৃত আবদুল মজিদের বড় ছেলে আবদুল মিয়া(৬৫)।প্রখ্যাত নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন এমন তথ্য এই প্রতিবেদকের কাছ জেনে দরিদ্র আবদুল মিয়া অশ্রুভরা চোখে স্থৃতি রোমন্থন করে জানান,-‘প্রায় ১৩ থেকে ১৫ বছর আগে ঢাকার রমনা বটমূলে যে বইমেলা হয়,সেই মেলায় খড়ম বিক্রির উদ্দেশ্যে টিএসসির রাস্তায় দুপুরে ক্রেতার আশায় বসেছিলেন।হঠাৎ খোলা রাস্তায় খড়মের পশরা সাজানো খড়ম দেখতে গাড়ী থামিয়ে হুমায়ূন সাব আর উনার সাথে আরেক ভদ্রলোক ৪/৫জোড়া খড়ম দরদাম না কইরাই আমারে প্যাকেট করতে কয়।আমি সাবেরে কই আমার তো প্যাকেট নাই।তহন সাবে নিজের হাতে এতোগুলান খড়ম খুব যতœ কইরা গাড়ীর মইধ্যে ভরেন।২টা ৫’শ টাহার নোট দিলে আমার মাথা আউলাইয়্যা যায়।মনে মনে ভাবি ব্যাডাটি বেক্কল নাকি!আমি কই সাব,এতো টাকা লাগবো না।৩’শ টাহা দিলেই চলবো।তুমি যে বাংলা বাঙ্গালী ও বঙ্গবন্ধুর বিলুপ্তির পথে এই খড়ম জুতো এখনো মানুষকে কেনার জন্য মনে করিয়ে দিচ্ছো,-এরজন্য বাকীটাকাটা তোমার জন্য বখশিশ দিলাম।হের লগে লগে সাবের সাথের আরেকটা সাব আমারে কয়,উনারে চিনো?আমার নেতিবাচক মাথা নাড়ানো দেইখ্যা ওনি কয়,টিভির নাটকে বাকের ভাইয়ের নামশুনছো? এইবার আমি বাকের ভাইয়ের অভিনয়ের কথা মনে হইতেই বলি বাকের ভাই তো মইরা গেছে।তাওে জর্জসাব ফাসি দিছে।কামঠা ভালা করে নাই।বছরের পর বছর জেলে থাকতো,কিন্তু এক্কেবারে ফাসি দিয়া …।সাব আমারে হুমায়ূন সাবেরে দেহাইয়া কয়,তিনি বাকের ভাইয়ের ঐ নাটকটা বানাইছেন।আমি বিষয়টা বুইঝ্যা সাবের পায়ে কদমবুছী করায় তিনি আমারে ধমক দেন।কয়,আল্লাহ আর মা-বাবা ছাড়া আর কাউরে কদমবুছী করলে হুনাহ হয়।স্যার,চইল্ল্যা যাবার সময় হাসতে হাসতে কয়,-‘এই খড়মওয়ালা…তোমার খড়মগুলো কয়দিন পর টিভিতে দেখতে পাইবা,কয়দিন পরে বিষয়টা দেখতে পাইবা’’।পরে আমার বড় মাইয়্যাডা আমারে জানাইছিলো,-সেই হুমায়ূন সাহেব সত্যি-সত্যি নাটকে মির্জা সাহেবের পায়ে শোভা পাইতো আমার তৈরী খড়ম।
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, রীতিনীতি আর আচার-আচরণের মধ্যে বিশেষ একটি স্থান দখল করে থাকলেও বিজ্ঞানের উত্কর্ষের কারণে খড়ম এখন বিলুপ্তপ্রায়। গ্রামাঞ্চলেও কালেভদ্রে এখন খড়মের দেখা মেলে! বয়স্ক কেউ কেউ খড়ম ছাড়া অন্য জুতা-স্যান্ডেল ব্যবহার করে স্বস্তি পান না। ওই সব মানুষের জন্য এবং এ প্রজন্মের কাছে খড়মের পরিচয় তুলে ধরতে, জনপ্রিয় করতে খড়ম বিক্রিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন আবদুল মিয়া।খড়ম বিক্রির জন্য তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। হাটবাজারে বিক্রি করেন খড়ম। তিনি জানান, এ প্রজন্মের অনেকে খড়ম দেখার জন্য ভিড়ও করে।
বাকের ভাইকে এই খড়ম পড়াতে হবে একটি নাটকে খড়মের ব্যবহার থাকবে বলে।কিন্তু খড়ম জুতো পাচ্ছিলাম।তুমি রক্ষে করলে।তুমি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধইরা রাখবাল জন্য টেকাটি দিলাম।এইডা খড়মের দাম দিলাম না।এইডা বানানো ধইরা রাইখ্যো,মিয়া’’।
কেউ কেউ কেনে। আবার বয়স্কদের অনেকেই খড়ম হাতে নিয়ে পুরনো দিনের স্মৃতি হাতড়ে ফিরেন। ৫৮ বছর বয়সী আবদুল মিয়ার বাঞ্ছারামপুরের সোনারামপুর গ্রামে।ছয়ফুল্লাকান্দি ইউপির মাছিমনগরের ঐতিহ্যবাহী শাহ রাহাত আলীর পক্ষকালব্যাপী ওরশ শরীফ উপলক্ষ্যে মাজার চত্বরে সম্প্রতি খড়মের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন আবদুল মিয়া।তিনি জানান,শিশুকাল থেকে মরহুম পিতা আ.আলীর কাছ থেকে পৈত্রিকসূত্রে খড়মের কারিগর হিসেবে কাজ করছেন।তিনি শত শত জোড়া খড়ম তৈরি করেন। কাঁঠাল কাঠ আর গাড়ির টায়ার দিয়ে খড়ম তৈরি করা হয়।প্রতি জোড়া খড়ম আবদুল মিয়ার খরচ পড়ে প্রায় ২৫ থেকে ৪০ টাকা।সে খড়ম বস্তায় ভরে দেশের বিভিন্ন হাটবাজার ও বিশেষ উপলক্ষ্য [যেমন ওরশ শরীফ,মেলা]খড়ম বিক্রি করেন প্রতি জোড়া ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকায়। আবদুল মিয়া কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন,-‘‘১২/১৫ বছর আগের কথা।ঢাহার বইমেলায় খড়ম বেচবার লাগি পুলিশ আমারে ঢুকবারদেয় নাই।পরে,টিিএস.সির রাস্তায় খড়মের পশরা সাজাইয়া বহি।একদিন দুপুরে কয়দনি আগে মারা যাওয়া হুমায়ূন আহম্মদ সাব তার সাথে ৩/৪জন লোক লইয়্যা আমার খড়মের দিকে তাকাইয়া গাড়ী থামান।কোন দাম-টাম না জিগাইয়াই একলগে ৫জোড়া খড়ম প্যাকেট করবার বলেন।আমার কাছে প্যাকেট আছিলো না।শেষে হুমায়ূন সাবের গাড়ীর ড্রাইভারের কাছে তিনি নিজ হাতে খড়ম গুলান নিয়া গাড়ীর পিছনে রাখবার বলেন।হুমায়ূন সাবের লগে থাকা এক ব্যাঠা কয়,উনারে চিনেছো নি মিয়া!!উনি বাংলাদেশের বড় লেখক!তহনও আমি এসব বুঝি নাই।এরপর হুমায়ূন সাব বুদ্ধী কইরা আমারে কয়,-টিভি দ্যাহো?আমি কই জোয়ান কালে মাইনষ্যের বাড়ীতে যাইয়্যা দেখছি।তহন তিনি আমারে কইলেন, বাকের মিয়ার নাটক দেখছো?আমার মনে পড়ায় কইলাম হ.দেখছি।ব্যাটারে শেষে ফাসি দেওয়ন ঠা ঠিক হয় নাই।তহন তারা সবাই কইলো তিনি এই নাটকটা বানাইছে।পরে বুইঝ্যা আমি খড়মের দাম নিতে চাইনাই।কিন্তু কি মনে কইরা হুমায়ূন সাব জোর কইরা ২ ঠা ৫’শ টাহার নোট আমার পকেটে ডুকাইয়া কইলো,সেই বাকের ভাইকে এই খড়ম পড়াতে হবে একটি নাটকে খড়মের ব্যবহার থাকবে বলে।কিন্তু খড়ম জুতো পাচ্ছিলাম।তুমি রক্ষে করলে।তুমি বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধইরা রাখবাল জন্য টেকাটি দিলাম।এইডা খড়মের দাম দিলাম না।এইডা বানানো ধইরা রাইখ্যো,মিয়া’’।।
আবদুল মিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের চট্রগ্রামের মাইজভান্ডারীর ওরশ শরীফ,আখাউড়ার খড়মপুরের মাজারের মাসব্যাপী ওরশে,কুমিল্লা,জব্বারের বলি খেলা,রাজশাহী, পাবনা,যশোরের লালন মেলা,বাউল মেলাসহ নানা জায়গায় খড়ম বিক্রি কইরা বাইচ্চ্যা আছি।বাঞ্ছারামপুরে বছরের ৬মাস থাহিআর ৬ মাস এলাকার বাইরে। প্রতিদিন গড়ে ১২০ জোড়া খড়ম বিক্রি হয়।’ তিনি আরো জানান, এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার চলে খড়ম বিক্রির টাকাতেই।
এই প্রজন্ম শতকরা ৯০ভাগই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খড়মের প্রসঙ্গে জানান, ‘খড়মের গল্প শুনেছি। কিন্তু কোনো দিন খড়ম পায়ে দেওয়া তো দূরের কথা, চোখেও দেখিনি।