সংসদে সুরঞ্জিতকে স্মরণ
নিজস্ব প্রতিবেদক : আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দশম সংসদের সুনামগঞ্জ-২ আসনের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে আজ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনের শুরুতে এ শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এর পর সংসদের রেওয়াজ অনুযায়ী বর্তমান সংসদের সদস্য প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আজ ভোরে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৭১ বছর।
শোক প্রস্তাবে স্পিকার বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান, বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সমাজসেবক হিসেবে জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
এর আগে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবন, কর্ম ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনায় অংশ নেন।
এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সরকারি দলের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর, শওকত আলী, আবদুল মতিন খসরু, উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, অধ্যাপক আলী আশরাফ, ড. আব্দুর রাজ্জাক, হুইপ শাহাবুদ্দিন, শেখ ফজলে নুর তাপস, মুহিবুর রহমান মানিক, আবদুল মজিদ খান, মৃণাল কান্তি দাস, বেগম আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, পীর ফজলুর রহমান, জিয়াউল হক মৃধা, জাসদের মইনউদ্দীন খান বাদল ও স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী আলোচনায় অংশ নেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদের বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। পাশাপাশি বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। তিনি দেশের সংসদ সংসদীয় রাজনীতির জন্য অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। সর্বোপরি তিনি গণমানুষের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। রওশন এরশাদ তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক হিসেবে তিনি তীক্ষ্ণ বক্তৃতার মধ্য দিয়ে সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী যুদ্ধ এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন উচ্চমানের মানুষ ছিলেন। তাঁর রাজনীতির বৈশিষ্ট ছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাজনীতি করতেন এবং রাজনীতির মধ্য দিয়েই তাঁর জীবনাবসান হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ব্যক্তিগত জীবনে একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। এর পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় তিনি একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হয়ে উঠেন। তিনি জানান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন অভিনয় শিল্পী এবং নাট্যকর্মীও ছিলেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সংসদ ও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রাখতেন। তিনি সব সময় দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৬ সালের ৫ মে সুনামগঞ্জের আনোয়ারপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ ইতিহাস বিষয়ে বিএ (অনার্স) এবং এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি এবং উর্দু ভাষায় দক্ষ ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাত্রজীবনেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতির পাশাপাশি নিজ এলাকার ও জাতীয় উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রাক্তন প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বর্তমানে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাবেক প্রাদেশিক ও গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। তিনি তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সপ্তম জাতীয় সংসদে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
নবম জাতীয় সংসদে তিনি আইন, বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি কার্যপ্রণালী-বিধি সম্পর্কিত কমিটি ও কার্য-উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সংসদ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন পার্লামেন্টারি সংস্থার সম্মেলন, শিক্ষা সফর ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেন।