তীব্র শীতেও খোলা আকাশের নিচে সাঁওতালরা
---
গাইবান্ধা প্রতিনিধি : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ইক্ষু খামারের জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া চার শতাধিক সাঁওতাল পরিবার শীতের প্রকোপে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া সাঁওতাল পরিবারগুলোর সদস্যরা অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর গত কয়েকদিনের ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে কর্মহীন মানুষগুলোর ভাগ্যে জুটছে না প্রয়োজনীয় খাদ্য ও শীতবস্ত্র।সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।
জানা গেছে, গত ৬ নভেম্বর হামলা ও উচ্ছেদ ঘটনার পর সাঁওতাল পরিবারগুলোর মাঝে কিছু সরকারি-বেসরকারি সংগঠন তাৎক্ষণিক খাবার ও শীতবস্ত্র বিতরণ করলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অল্প। শীতবস্ত্রের অভাবে কম্বল গায়ে দিয়ে আর দিনরাত খড় জ্বালিয়ে তাদের শীত নিবারণ করতে হচ্ছে।
এদিকে গত কয়েকদিন গাইবান্ধা জেলাসহ উত্তরজনপদে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। দিনের বেলাতেও গায়ে গরম কাপড় পড়ে বের হতে হয়। সন্ধ্যার পর থেকে ঘন কুয়াশায় শীত বাড়তে থাকে। শীতের তীব্রতা বাড়ার কারণে এখানে আশ্রয় নেওয়া অনেক শিশু ও বৃদ্ধ শীতজনিত সর্দি ও জ্বর-কাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু বাইরে যেতে না পারায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
শনিবার দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, খড় ও ছোট ছোট ত্রিপলের (তাবু) নিচে আশ্রয় নেওয়া সাঁওতালদের অনেকে এক পোশাকে,কেউবা শরীরে কম্বল জড়িয়ে শীত ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। তারা জানান, সন্ধ্যার পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত এসব মানুষ খড় ও লাকড়ি জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন।
মাদারপুর গির্জার সামনে আশ্রয় নেওয়া আমেনা হেমরন বলেন, ‘হামলা ঘটনা পর আমরা সব হারিয়ে ফেলেছি। পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নেই । ঘরে খাবার নেই, মাথার ওপরে চালা নেই । গত দুই মাস ধরে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি।’
কিসকো মিনতি বলেন, ‘এবছর এত শীত যে শরীর কেঁপে উঠছে। ঘরে কম্বল ও ভালো বিছানা নাই। তার ওপর কুয়াশার পানি তাবুর ভেতরে পড়ছে।’
মাদারপুর সাঁওতাল পল্লিতে আশ্রয় নেওয়া কিসকো সরেন বলেন, ‘তাবুর নিচে থাকলে শীত বেশি লাগে। রাতে তাবুতে বেশি বাতাস ঢোকে। সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত কুয়াশার কারণে তাবুর ওপর পানি পড়ে। এতে আরও বেশি শীত লাগে।’
পলুস মাস্টার বলেন, ‘সাহায্য পাওয়া দু-একটি কম্বল দিয়ে কিছুই হচ্ছে না। কারণ খোলা আকাশের নিচে তাবুতে মাটির ওপর সামান্য খড় দিয়ে তার ওপর একটি কম্বল বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি কম্বল স্ত্রী-সন্তানসহ গায়ে দিয়ে কেমন করে শীত কাটে। তাই বাধ্য হয়ে তাবুর পাশে খড় জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছি।’
টাটু টুডু বলেন, ‘খেয়ে না খেয়ে তীব্র শীতেও জমির অধিকার ফিরে পেতে নানা কষ্টে বেঁচে আছি। আর হামলা ঘটনারও দ্রুত বিচারক হওয়া দরকার। সরকারের কাছে আমাদের এখন এটাই দাবি।’
এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. জহিরুল হক বলেন,‘খোলা আকাশের নিচে থাকা সাঁওতালদের প্রত্যেক পরিবারকে দুটি করে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু সাঁওতালদের পক্ষ থেকে সরকারি ত্রাণ গ্রহণে আপত্তি থাকায় শীতবস্ত্র বা ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। তবে তারা চাইলে শীতবস্ত্রসহ ত্রাণ বিতরণ করা হবে।’
প্রসঙ্গত,গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ১ হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ওই জমিতে মিল কর্তৃপক্ষ আখ চাষ না করে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর কাছে লিজ দেয়। তারা লিজ নিয়ে জমিতে তামাক, ধান ও শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতে থাকে। এছাড়া এসব জমিতে ১২টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে প্রভাবশালীরা।
দু’বছর আগে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাপ-দাদার জমি ফেরত দেওয়ার কথা বলে সাঁওতালদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে। গত ৬ নভেম্বর সাঁওতালদের সঙ্গে পুলিশ ও ইক্ষু শ্রমিকদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে তিন সাঁওতাল পুরুষ নিহত হন। আহত হন পুলিশসহ ৩০ জন। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি ও সাঁওতালদের পক্ষ থেকে দুটি মামলা দায়ের হয়।