শনিবার, ১৫ই জুলাই, ২০১৭ ইং ৩১শে আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

এখনও খোঁজ মেলেনি ২০ জঙ্গির

AmaderBrahmanbaria.COM
জানুয়ারি ৯, ২০১৭

---

নিজস্ব প্রতিবেদক : জঙ্গিবিরোধী চলমান অভিযান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফল হলেও বিপদ পুরোপুরি কেটে যায়নি। কারণ পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে দুর্ধর্ষ ৫৭ জন নিহত হলেও অধরা রয়ে গেছে প্রায় ২০ শীর্ষ জঙ্গি নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গি নেতা আনসার আল ইসলামের সামরিক প্রশিক্ষক সৈয়দ জিয়াউল হক। তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণার ছেয় মাস পার হলেও মেলেনি দুর্ধর্ষ এ জঙ্গিনেতার খোঁজ।

 

পাশাপাশি সম্প্রতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাইনুল ইসলাম মুছা, বাসারুজ্জামান, সাগরসহ কমপক্ষে সেকেন্ড ধাপের ১৫ থেকে ২০ জঙ্গি নেতা। সক্রিয় রয়েছেন সিরিজ বোমা হামলা মামলায় ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের অনুসারী সাবেক জেএমবির একাধিক নেতা।

জানা গেছে, আনসার আল ইসলাম ও নব্য জেএমবি, পুরাতন জেএমবি মিলিয়ে এখনও অধরা রয়ে গেছে জঙ্গি গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতাধিক জঙ্গি নেতা। মাঠ পর্যায়ে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন জঙ্গি সদস্য। জঙ্গি গ্রুপে যোগ দেয়ার পরপরই একেকজন হয়ে উঠে শীর্ষ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। পুলিশের দাবি পলাতক জঙ্গিরা পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। অনেকের ব্যাপারে সব তথ্য পাওয়া গেছে। এসব জঙ্গিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।

সূত্র মতে, পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে প্রকাশক, ব্লগার ও লেখক হত্যার হোতা আনসার আল ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের পুরস্কার ঘোষিত সামরিক প্রশিক্ষক বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, মাঠ পর্যায়ের অপারেশন বাস্তবায়নকারী সেলিম ও সাজ্জাদসহ তিন শীর্ষ জঙ্গিনেতাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে মেজর জিয়া ছাড়া ব্লগার, লেখক হত্যার হোতা পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গির ছবি প্রকাশের পর একজন বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় এবং তিনজনকে গ্রেফতার হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।

অন্যদিকে নব্য জেএমবির পলাতক নেতা বাসারুজ্জান ওরফে ককটেল, মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা, পুলিশের গুলিতে সম্প্রতি নিহত নুরুল ইসলাম মারজানের ভগ্নিপতি সাগরসহ নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের ১২ থেকে ১৫ জনকে গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। এসব জঙ্গি আত্মগোপনে থেকে নব্য জেএমবিকে সুসংগঠিত করছেন। এসব জঙ্গির রিক্রুটিং করা নতুন নতুন জঙ্গি সদস্য তৎপর রয়েছে বলে মনে করছেন জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণকারীরা।

নব্য জেএমবির পাশপাশি পুরনো জেএমবিসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত একাধিক জঙ্গি সংগঠনের কমকাণ্ডও চলছে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে। নিষিদ্ধ হলেও প্রকাশ্যেই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে হিজবুত তাহরীরের মতো জঙ্গি সংগঠন। এসব সংগঠন ও পলাতক জঙ্গিরা যেকোন মুহূর্তে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শুক্রবার জঙ্গি দমন বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান, দেশে পালিয়ে থাকার মতো কোন জায়গা জঙ্গিদের আর থাকবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। মুসাসহ যেসব জঙ্গি পলাতক রয়েছে শীঘ্রই তারা ধরা পড়বে।

আইজিপি একেএম শহীদুল হক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশ জঙ্গিই নিহত হয়েছে। পলাতক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ক্রমেই তা জোরদার করা হবে। আইজিপি বলেন, সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত সৈয়দ জিয়াউল হকের ব্যাপারে পুলিশের কাছে সব ধরনের তথ্য রয়েছে। যেকোন সময় সৈয়দ জিয়াকে গ্রেফতার করা হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে ওই হত্যাকাণ্ডসহ ব্লগার, প্রকাশক ও আমেরিকান অ্যাম্বাসির কর্মকর্তা জুলহাস মান্নানসহ মুক্তমনা ব্যক্তিদের হত্যায় আনসার আল ইসলামের জড়িত থাকার বিষয়টি পুরোপুরি প্রমাণিত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আনসার আল ইসলামের সামরিক প্রশিক্ষক সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত সৈয়দ জিয়াউল হকের নির্দেশনার বিষয়টি তদন্তে পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, বহিষ্কৃত জিয়ার কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়া শীর্ষ পর্যায়ের জঙ্গি শরীফ, সেলিম, সিফাত, রাজু, সিহাব ও সাজ্জাদ মাঠ পর্যায়ে আনসার আল ইসলামের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ড. অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে সর্বশেষ ইউএস অ্যাম্বাসির কর্মকর্তা জুলহাস মান্নানসহ দু’জনকে হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিল। পুরস্কার ঘোষিত ওই ছয় জঙ্গির মধ্যে শরীফকে ধরতে অভিযান চালানো হলে পুলিশের অভিযানে শরিফ মারা যায়। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয় সিফাত, রাজু ও সিহাব। তবে দুর্ধর্ষ জঙ্গি সেলিম ও সাজ্জাদ এখানও গ্রেফতার হয়নি।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, আনসার আল ইসলামের দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা ধরা পড়ার গত জুলাই মাসে নব্য জেএমবি গুলশানে ভয়াবহ হামলা চালায়। ওই হামলায় দেশি বিদেশি ২০ নাগরিককে হত্যা করা হলেও ওই ধরনের হামলার পক্ষে ছিল না আনসার আল ইসলামের জঙ্গিরা। এরপর শোলাকিয়া ঈদ জামাতে হামলা চেষ্টার পর দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। বিশেষ করে গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গিদের ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সারোয়ার জাহান, তামিম চৌধুরী, বহিষ্কৃত মেজর জাহিদুল হকসহ ৩৪ জনের বেশি জঙ্গি মারা গেছে। যারা সবাই কোন না কোনভাবে গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত। সর্বশেষ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের অভিযানে উত্তরাঞ্চলের নব্য জেএমবির কমান্ডার সাদ্দামসহ গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী নুরুল ইসলাম মারজান মারা যায়। নুরুল ইসলাম মারজান ছিল পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গি নেতা। গুলশান হামলার পর সৈয়দ জিয়াউল হক, তামিম চৌধুরীকে ধরতে পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে নুরুল ইসলাম মারজানকেও ধরার ব্যাপারে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। এর মধ্যে পুরস্কার ঘোষিত তামিম চৌধুরী নারায়াণগঞ্জে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ২ সহযোগীসহ মারা যায়। আর সম্প্রতি মারা যায় নুরুল ইসলাম মারজান।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম, হত্যাকাণ্ড, হামলা ও নাশকতার ঘটনা ছিল ১৫৮টি। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযানে ৫৭ জঙ্গি মারা গেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ২৩৮ জঙ্গিকে। দেশব্যাপী জঙ্গি কার্যক্রম ঠেকাতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তত্ত্বাবধায়নে স্পেশাল টাস্কফোর্স গ্রুপ (এসটিজি), এলআইসি, র‌্যাব, কাউন্টার টেরোরিজমসহ এবাধিক ইউনিট কাজ করছে। বিশেষ করে জঙ্গিদের পারিবারিক জীবন, পলাতক ও বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের ডাটাবেজের কাজ করছে এসটিসি।

এছাড়া জঙ্গি সম্পৃক্তার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে মুক্তি পাওয়াদের মধ্যে কারা কারা ফের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হচ্ছে এদের গতিবিধিও এসটিসির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি যে কয়টি জঙ্গিবিরোধী অভিযান হয়েছে এবং জঙ্গি আস্তানার অস্তিত্ব মিলেছে এর মূলে ছিল এসটিজির কার্যক্রম।

কাউন্টার টেরোরিজমের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিবিরোধী ধারাবাহিক অভিযানের পর নব্য জেএমবির কোমর ভেঙে গেছে। নতুন করে জঙ্গি হামলা করার মতো সামর্থ্য না থাকলেও তারা গোপনে গোপনে সুসংগঠিত হতে পারে। যেসব জঙ্গি পলাতক রয়েছে তারা এখন নতুন করে জঙ্গি গ্রুপে সদস্য সংগ্রহ করতে পারে।