নতুন কমিটি: রাজশাহী বিএনপিতে বিশৃঙ্খলা
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীতে বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনু ও নাদিম মোস্তফার দ্বন্দ্ব প্রায় দেড়যুগ ধরে। তাদের সেই দ্বন্দ্ব নিরসনে চেষ্টা চালিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রকাশ্যেই চলেছে তাদের এ দ্বন্দ্ব। তবে এবার নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন মিজানুর রহমান মিনু ও মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল।
সাত বছর পর সম্প্রতি রাজশাহী মহানগর বিএনপির গঠিত নতুন কমিটি নিয়ে তাদের এই দ্বন্দ্ব এবার প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এ কমিটিতে মিনুকে বাদ দিয়ে বুলবুলকে সভাপতি করা হয়েছে। আর সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলনকে।
নতুন কমিটির বিরুদ্ধে মিনু পক্ষের নেতাকর্মী মাঠে নেমেছেন। কমিটি বাতিলের দাবিতে নেতাকর্মীদের একাংশ বিক্ষোভও শুরু করেছেন। গঠিত হয়েছে রাজশাহী বিএনপি রক্ষা কমিটি!
জানা গেছে, এই কমিটি গঠনের আগে দলীয় কার্যালয়ে তালা ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে লিখিত নালিশও জানিয়েছেন পদ বঞ্ছিত নেতাদের কয়েকজন। মিজানুর রহমান মিনুর ইঙ্গিতে তার অনুসারীরা এসব করছে বলে দাবি করেছেন বুলবুল-মিলন সমর্থকরা। তবে তাদের শান্ত করতে বুলবুল কাজ করছেন বলেও জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীতে মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে নাদিম মোস্তফার প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। এই প্রথম বুলবুলের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন তিনি। গত সিটি নির্বাচনে মিনুকে বাদ দিয়ে বুলবুলকে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলে তখনও তাদের এতোটা বিরোধ তৈরি হয়নি। ওই নির্বাচনে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করায় মেয়র নির্বাচিত হন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এরপর কয়েকটি মামলায় তিনি কারাগারে যান। ফলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর তিনি এখন জামিনে রয়েছেন। এরই মধ্যে মহানগর বিএনপির সভাপতির পদ পেলেন তিনি।
দলীয় সূত্র জানায়, গত ২৭ ডিসেম্বর সাত বছর পর কেন্দ্র থেকে প্রভাবশালী দুই নেতা মিজানুর রহমান মিনু ও নাদিম মোস্তফাকে বাদ দিয়ে রাজশাহী নগর ও জেলায় বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়। নগর বিএনপির সভাপতির পদ থেকে কেন্দ্রীয় বিএনপির উপদেষ্টা ও সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনুকে বাদ দিয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
আর জেলায় নাদিম মোস্তফাকে বাদ দিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তোফাজ্জল হোসেন তপুকে। কমিটি ঘোষণার পর থেকে মিনু ও নাদিম মোস্তফার পক্ষের কয়েকজন নেতা নতুন কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। তবে তাতে খুব একটা সাড়াও মিলছে না বলে দাবি করেছেন মহানগর বিএনপির একাধিক সূত্র। তবে নতুন কমিটি নিয়ে জেলা ও মহানগর বিএনপিতে এখন চলছে চরম বিশৃঙ্খলা
এদিকে নগরীর মতিহার থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক ডিকেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রাজশাহী মহানগর বিএনপির সকল স্তরের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে ও মতামতের ভিত্তিতে রাজশাহী বিএনপি রক্ষা কমিটি ঘোষণা হয়েছে। রাজশাহী বিএনপি রক্ষা কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে মহানগর বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি নজরুল হুদাকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে বোয়ালিয়া থানা বিএনপির সভাপতি সাইদুর রহমান পিন্টুকে। ৩১ সদস্য বিশিষ্ট এ আহ্বায়ক কমিটির সবাই মিনুর পক্ষের বলে জানা গেছে। এ কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ মিনুপন্থী কয়েকজন নেতা নতুন কমিটি ঘোষণার দিন দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন।
এদিকে রাজশাহী বিএনপি রক্ষা কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, রাজশাহী মহানগরের ঘোষিত কমিটি স্থগিত করে সম্মেলন ও কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি করতে হবে। তা না হলে আগামীতে মহানগর বিএনপির সকল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বিএনপি রক্ষা কমিটির নেতৃত্বে পালন করা হবে। এ দাবিতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল মতিহার থানার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক ডিকেন। বেলা ১১টায় বালুর ঘাট মাঠে এ সংবাদ সম্মেলনের কথা ছিল। তবে রহস্যজনক কারণে সেই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। বুলবুল শিবিরের নেতাকর্মীরা দাবি করছেন, মিনু শিবিরের নেতারা তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।
তবে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন শওকতের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরের চেষ্টা চালিয়েছেন বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নগরীর বাটারমোড় এলাকায় অবস্থিত ওই কার্যালয় ভাঙচুরের চেষ্টা চালান ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির কিছু নেতাকর্মী। তারা দরজায় লাগানো তালায় হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিয়েও ভাঙতে পারেননি।
এদিকে মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বিএনপিপন্থি কাউন্সিলররা। সিটি করপোরেশনের ১৭ জন কাউন্সিলরের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সম্মেলনের মাধ্যমে নগর বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনের দাবি জানানো হয়।
রাসিকের ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নগর বিএনপির সাবেক যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আমিন বলেন, কারো প্রতি কোনো রাগ-ক্ষোভ থেকে নয়, আমার মনে হয় দলের স্বার্থে মহানগর কমিটির পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। জেলারও তাই করা দরকার। সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি না হলে নেতাকর্মীরা হতাশায় ভোগেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে নতুন কমিটির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, নেতৃত্ব আকড়ে ধরে রাখার জন্য একটি পক্ষ গভীর ষড়যন্ত্র করছে। এদের পেছনে বাদপাড়া ‘বড়ভাই’ রয়েছেন। কিন্তু এটা করা ঠিক না। নতুনদের হাতে নেতৃত্ব না দিলে দলে নেতা তৈরি হবে না। এতে দলেরই ক্ষতি হবে। দলের চেয়ারপারসন কমিটি করে দিয়েছেন, সেটাই চূড়ান্ত। এ নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
এদিকে জেলা কমিটি নিয়েও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে নেতাকর্মীদের মাঝে। তোফাজ্জল হোসেন তপুকে সভাপতি ও মতিউর রহমান মন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩৭ সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন অপর অংশের নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে কেন্দ্র থেকে এ কমিটি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা এই কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন চান।
তপু-মন্টু কমিটি হটাতে শুক্রবার রাতে আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামরুল মনিরের বাসায় বৈঠক করেছেন বিএনপির বিভিন্ন উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেয়ররা। পরে তারা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সম্প্রতি তোফাজ্জল হোসেন তপু ও মতিউর রহমান মন্টুর নেতৃত্বে যে কমিটি গঠিত হয়েছে, আমরা মনে করি এদের দিয়ে রাজশাহী জেলায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই কমিটি নেতৃত্ব চরিত্রহীন, জনসাধারণের অর্থ লুণ্ঠনকারী ও সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। রাজশাহীবাসীর অন্তরে তাদের প্রতি কোনো আস্থা নেই। দলে নেতৃত্ব প্রদান করার মতো নূন্যতম যোগ্যতা এদের নেই বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
ওই বিবৃতিতে তারা অবিলম্বে এই কমিটি স্থগিত করে যোগ্য নেতৃত্বের কমিটি গঠনের দাবি জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন- চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাঈদ চাঁদ, পুঠিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম জুম্মা, মোহনপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ, তানোর উপজেলা চেয়ারম্যান এমরান আলী মোল্লা, তানোর পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান মিজান, পুঠিয়া পৌর মেয়র আশাদুল হক, চারঘাট পৌর মেয়র জাকিরুল ইসলাম বিকুল ও নওহাটা পৌর মেয়র মকবুল হোসেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির নতুন কমিটির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু বলেন, ‘কমিটি দেয়ার আগে দলের চেয়ারপারসন সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর তিনি কমিটি দিয়েছেন। কে যোগ্য, আর কাকে নেতৃত্ব দিতে হবে তা তিনিই ভালো জানেন। তবে পদবঞ্চিতরা নানা ষড়যন্ত্র করছেন। কিন্তু এই কমিটির বিরোধীতা করা মানে ম্যাডামের বিরোধীতা করা। তাই সবার উচিত কমিটি মেনে নেয়া।