সাবেক সচিবের স্ত্রী ছেলের বউয়ের নির্যাতন সইতে না পেরে এখন প্রবীণ নিবাসে
ডেস্ক রিপোর্ট।। ‘একদিন রুটি তৈরির বেলুন দিয়ে মাথায় আঘাত করে ছোট ছেলের বউ। মাথার আঘাত নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে মিথ্যা বলেছি। জানিয়েছি বাথরুমে পড়ে গেছি। পা পিছলে পড়ে আঘাত পেয়েছি। এখনও মাথায় সেই আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। একটা কাজের মেয়েকেও তো এতো নির্যাতন করতে পারে না। এটা আইনের বাইরে।’
ছেলের বউয়ের এমন শারীরিক নির্যাতনের কথা চেপে রাখতে না পেরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন সাবেক স্বাস্থ্য সচিবের স্ত্রী সৈয়দ জাহানারা বেগম চৌধুরী মলি। ছেলের বউয়ের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে থাকার জন্য তিনি এসেছেন রাজধানীর আগাওগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাসে।
এই অবস্থায় আগামীকাল সোমবার পালিত হতে যাচ্ছে ২৮ তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রবীণদের স্মরণ পরম-শ্রদ্ধায়’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আগামীকাল পালিত হবে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস-২০১৮।
দিবসটি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা হয় জাহানারা বেগমের সাথে। প্রবীণ নিবাসের হোম ম্যানেজারের কাছ থেকে প্রবীণ নিবাসে থাকার জন্য পূরণীয় ফর্ম সংগ্রহ করছিলেন তিনি। জীবনের শেষ সময়ে এসে যখন সবাই চায় নিজের ছেলে-মেয়েদের কাছে থেকে, নাতি-নাতনির সাথে হেঁসে-খেলে বাকি জীবন পার করে দিতে। সেখানে প্রবীণ নিবাসে আসার জন্য খুব ব্যস্ততা দেখালেন জাহানারা বেগম। জানতে চাইলেন কত টাকা লাগবে, তাড়াতাড়ি আসতে পারবেন কী না? এমন বিভিন্ন প্রশ্ন।
৬২ বছর বয়সী বৃদ্ধা জাহানারা বেগমের এমন প্রশ্নে প্রবীণ নিবাসে আসার এমন আগ্রহের বিষয়ে কৌতুহল তৈরি হয়। সুসজ্জ্বিত পোশাকে জাহানারা বেগমকে দেখে এবং কথা শুনে মনে হওয়ায় স্বাভাবিক অভিজাত পরিবারের অথচ প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে প্রবীণ নিবাসে চলে আসতে চাইছেন তিনি। সেই আগ্রহে কথা বলতে চাইলে প্রবীণ নিবাসের বারান্দায় একান্তে বিডিমর্নিং এর এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন জাহানারা বেগম।
জাহানারা বেগমের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁর বাবার বাড়ি ছিল নোয়াখালী। বাবা ছিলেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক(ডিসি ফুড)। স্বামী এম বশির উদ্দিন চৌধুরি ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের যুগ্ম সচিব। ২২ বছর আগে তিনি মারা যান। সে সময় দুই ছেলে নিয়ে সংগ্রামী জীবন শুরু করেন জাহানারা বেগম। স্বামীর চাকরি থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে বনশ্রীতে ভাড়া বাসায় অনেক কষ্টে করে বড় ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। বড় ছেলে পড়াশোনা শেষে বিসিএস ক্যাডার হয়ে চাকরি নেন কাস্টমসে। বাড়ি-গাড়ি সব কিছুই করেছেন তিনি। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, কিনেছেন অনেক জমিও।
জাহানারা বেগম থাকার কারণে বড় ছেলের বউ বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যান। মিরপুরের কাজীপাড়ায় বড় ছেলের বাসায় দীর্ঘদিন থাকলেও ছেলের বউয়ের নির্যাতন-অপমান সইতে না পেরে চলে আসেন ছোট ছেলের বাসায়। ছোট ছেলে থাকেন রাজধানীর মধ্য বাড্ডায়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি।
দুই ছেলের কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘দুই ছেলে ছিল পৃথিবীর সেরা। পৃথিবীতে মা ছাড়া ওদের আর কেউ ছিল না। কিন্তু বউ আসার পরই ওরা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন ওরা আর আমার খোঁজ নেই না। আমার ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন দেখে নাতি-নাতনিরা প্রতিবাদ জানায় বলে ওদেরও আমার কাছে আসতে দেয় না ছেলে বউ। ছেলের বউ বলে ওরা(নাতি-নাতিনরা) আসলে আমি নাকি খারাপ করে ফেলবো।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাবার লিখে দেয়া জমি বিক্রি করে ছোট ছেলেকে কয়েক লাখ টাকা দিয়েছি। এখন সেই ছোট ছেলের বউ আমার সামনেই ছোট ছেলেকে বলে, তোমার মাকে আমি এই বাড়ি থেকে তাড়াবোই।’
এক সময় মহারাণীর মতো থাকতেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আজ একটা চাকরানীর চেয়ে খারাপ ব্যবহার করা হয় আমার সাথে। আমার সাথে তুই-তুকারি করে কথা বলে ছোট ছেলের বউ।’
এক সময় বাবা ও স্বামীর আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকার কারণে পোশাক আশাকের কোন কমতি ছিল না। দামি দামি শাড়ি কিনে সংরক্ষণ করেছিলেন। এখন সেই শাড়িসহ অন্যান্য ভালো পোশাক পড়ার বিষয় নিয়েও ছেলের বউ প্রশ্ন তুলে বলে জানান তিনি। জাহানারা বেগমের কাছ থেকে শোনা গেল ছেলের বউ বলে ‘বুড়ি হয়েছে তবুও দামিদামি শাড়ি পড়ে।‘ ছেলে এসব কথার প্রতিবাদ করলেও ছেলের বউ তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়।
বউদের সাথে ছেলেরা পেরে উঠছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ছেলের বউ যদি ১০ টাকা দিতে বলে তাহলে সেই টাকা দিবে। ছেলেরা প্রতিবাদ করলেই বউরা ডিভোর্স দেয়ার হুমকি দেয়। মা হিসেবে সেটা আমি মেনে নিতে পারি না। কোন মা তার ছেলের সংসার ভাঙুক সেটা চায় না। সে কারণে আমি ছেলেদের নিষেধ করি কিছু না বলার জন্য।’
জানা যায়, ছেলের বউদের এই নির্যাতন সইতে না পেরে প্রায় বছর খানেক গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু জীবনের দীর্ঘ সময় সরকারি কোয়ার্টারে ভালো পরিবেশে শহরে থেকে গ্রামে থাকতে পারেননি। বিভিন্ন সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাছাড়া কোন কাজের লোকও পেতেন না। সে কারণে আবার ছোট ছেলের বাসায় চলে আসেন।
ছোট ছেলের বউয়ের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা দেন জাহানারা বেগম। কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই আবার তার ওপর নেমে আসে আগের মতো নির্যাতনের খড়গ।
ছেলের বাসায় ডাইনিং টেবিলেও খেতে বসতে দেয়া হয় না বলে অভিযোগ করেন তিনি। জানান, ছোট ছেলে রুমে খাবার দিয়ে যায়। নিজের কোন কিছু প্রয়োজন হয় কী না এগুলোও কোনদিন খোঁজ নেয় না ছেলে। এসব কথা বলতে বলতে আবারও কেঁদে ফেলেন জাহানারা বেগম।
নিজের ভাই-বোনদের কাছে যেতে ইচ্ছা করে কী না? জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘যেখানে নিজের ছেলের বউরা এমন শারীরিক মানসিক নির্যাতন করে। সেখানে তাদের ছেলের বউরা আমাকে দেখবে এটা প্রত্যাশা করা যায় না। তাছাড়া আমি ছেলেদেরকে অন্য কারো কাছে ছোট করতে চাই না। নিজের আত্মসম্মানে বাঁধবে।’
নিজের বউদের সব সময় অন্যদের কাছে ভালো বলে উপস্থাপন করতেন তিনি। বিশ্বাস করতেন একদিন হয়তো ছেলের বউরা ভালো হয়ে যাবে। তাকে ভালোভাবে দেখবে। নিজের গহনা, দামি-দামি শাড়িগুলো ছেলের বউদের দিয়েছেন। কিন্তু তারা কখনও আপন করে নিতে পারেনি তাঁকে।
জাহানারা বেগমের এক সময় কষ্ট সহ্য করার মতো শক্তি সামর্থ্য ছিল। এখন আর সেটা নেই। বিশ্বাস ছিল ছেলে বউদের ভালোবাসলে হয়তো বয়স্ক হলে তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো তার উল্টোটা। জীবনের শেষ সময়ে শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন তার নিত্যসঙ্গী হয়েছে।
এত এত নির্যাতন করার কারণ হিসেবে জানান, ‘বাবার বাড়িতে যে সম্পত্তি আছে সেটা বিক্রি করার কথা ভাবছিলাম। সেই সম্পত্তি বিক্রি করার কথা শুনে তারা এমন করছে। তারা চাই আমি মরে গেলে তারা এই জমি পাবে। ছেলের বউ প্রায় সময় আমার সামনে আমার মৃত্যু কামনা করে বিভিন্ন কথা বলে।’
প্রবীণ নিবাসে আসার বিষয়ে ছেলেরা জানে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ছোট ছেলেকে প্রবীণ নিবাসে থাকার কথা জানিয়ে এসেছি। সেও আর বাঁধা দিতে চাই না। কারণ ও পারে না। বউকে থামাতে না পেরে মারধর পর্যন্ত করেছে। কিন্তু পরে বউয়ের বাসার লোকজন এসে হুমকি দিয়ে যায়। আমাকেও দেখে নেয়ার হুমকি দিয়ে যায়।’
ছেলের বউয়ের এমন নির্যাতন নিজ পরিবারের সদস্যদের কখনও জানাননি শুধু ছেলের কথা মনে করে। ছেলের সম্মানের জন্য। ছেলে ও বউদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবেননি। কারণ সরকারি চাকরি করা ছেলের চাকরি চলে যাবে, ছেলেদের হাতে হাতকড়া পড়বে এটা মেনে নিতে পারবেন না তিনি।
জাহানারা বেগম জানান, ‘কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই মুখের সামনে আঙুল উচিয়ে ছেলেকে চুপ করার জন্য ধমক দিতে থাকেন। ছেলের সামনে এমন করলেও কোন প্রতিবাদ করেন না ছেলে। এসব কথা বলতে বলতে দু’চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না তিনি।
কান্নাকণ্ঠেই বলেন, ‘নাতিকে আসতেও দেয় না কাছে। বলে ডাইনীর কাছে যাওয়া যাবে না। নাতিকে শিখিয়ে দেয় ওকে(বৃদ্ধাকে) দাদী বলবি না, বুড়ো ডাইনি বলবি।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘বাবার বাড়ির এই জমি বিক্রি করতে চেয়েছি শুনেই এই টাকা নেয়ার জন্য ছেলের বউ এই নির্যাতন করছে। অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রয়োজনে আশ্রমে গিয়ে থাকতে না হলে কোনদিন বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলবে।’
খাওয়ার সময় কান্না আসে জানিয়ে বলেন, ‘আমাকে যে খাবার দেয় সেই খাবার আমি যে সময় কুকুর বিড়াল পুষতাম তাকেও এই খাবার খায়তে দিতাম না।’
ছেলের বাসায় থাকার চেয়ে জেলখানায় থাকা অনেক ভালো জানিয়ে আবেগতাড়িত কণ্ঠে এই মা বলেন, ‘ছেলের বউ আমাকে অন্য কারো বাড়ি যাওয়ায় নিষেধ করেছেন। অন্য কারো বাড়িতে গিয়ে নাকি তার বদনাম করবো এই ভয়ে কারো বাসায় যাওয়া আমার বন্ধ করে দিয়েছে।’
সারাক্ষণ বাসার মধ্যে বন্দি থাকতে হয় জানিয়ে বলেন, ‘ওরা(ছেলে-বউ) বাইরে গেলে ঘরে তালা দিয়ে যায়। যদি উপরে অন্য বাসায় গিয়ে একটু গল্প করি।’
বাসায় না থাকলে কোথায় যান তার কৈফিয়ত চান জানিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে কান্না করে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা স্বাধীনতা দিয়েছে কিন্তু শেখ হাসিনা জানে না শাশুড়িরা কত নির্যাতিত। ঘরে ঘরে এমন অনেক শাশুড়ি নির্যাতিত হচ্ছে প্রতিদিন।’
ছেলে বউদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অনেক আগেই নিতে পারতেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো। আমি যে মা। বাবা হলে হয়তো পারতাম। সারারাত কান্না করে, জিকির করে দিন কাটে বলে জানান এই মা।
এই প্রতিবেদককে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে আমাকে আগে কত সেবা করতো। আর এখন আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। খাবার দেয়ার সময় অন্যদিকে তাকিয়ে খাবার দিয়ে চলে যায়।’
মান-সম্মান নিয়ে যেন মারা যেতে পারেন এমন ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে এই মা বলেন, ‘আমি প্রতিমূহুর্তে আমার মৃত্যু কামনা করি। যেন আমার সম্মানের সাথে মৃত্যু হয়। আমাকে যেন আর অন্য কারো সামনে অপমানিত হতে না হয়।’
ছেলের ভাড়া বাসার বাড়িওয়ালীর সামনে নিজের গায়ে হাত উঠিয়েছে দাবি করে এই মা তার শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখায়। যে আঘাতগুলো স্পষ্ট বুঝা যায়। দীর্ঘ সময় কথা বলার সময় এই মা নিজের চোখের পানি নিবৃত করতে পারেনি। অবিরাম কান্নায় চোখ ভিজিয়েছেন কখনও চোখের পানি বেয়ে পড়েছে। তবে সব সময় চেয়েছেন ছেলেরা যেন ভালো থাকে। ছেলেদের সংসার যেন সুখে থাকে। বাকি জীবনটা প্রবীণ নিবাসে কাটিয়ে দিবেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে ছেলে আর বউদের জন্য ভালো কামনা করে কাটিয়ে দিবেন। কোন আক্ষেপ রাখবেন না। এটাই তার শেষ ইচ্ছা। মৃত্যুর পরে প্রবীণ নিবাস থেকে যেন ছেলেরা লাশ গ্রহণ করেন সে জন্য আবেদন ফর্মে দুই ছেলের নাম লিখবেন তিনি। এখন অপেক্ষা প্রবীণ নিবাসে থেকে সন্তানদের সুখ কামনা করার। আর সম্মান নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া। উৎস: বিডিমর্নিং