ডেমু চালাতে অক্ষম বাংলাদেশ রেলওয়ে
দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও বিকল হলে সারানোর জন্য বাংলাদেশে ডেমু ট্রেনের জন্য নেই নির্ধারিত ওয়ার্কশপ। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ডেমু ট্রেন সম্পূর্ণ একটি নতুন প্রযুক্তি। যার সঙ্গে পরিচিত নয় রেলের মেকানিক ও প্রকৌশলীরা। এছাড়াও সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার চলাচলের উপযোগী এ ট্রেন একমাত্র বাংলাদেশেই চলছে ১৩০ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়েও বেশি পথ।
শুধু তাই নয় এক সেট ডেমুতে ১৪৯ জন যাত্রী বসে এবং ১৫১ জন দাড়িয়ে যাতায়াত করতে পারেন। অথচ নির্দিষ্ট এ পরিমাণের চেয়েও কয়েকগুন বেশি যাত্রী ধারণ করায় খুব অল্প সময়েই বিকল হয়ে রেলের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে পড়ে আছে বেশ কয়েক সেট ডেমু।
ডেমু ক্রয় প্রকল্পের শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ও পিছুটান থাকলেও তা উপেক্ষা করেই তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের স্বপ্ন পূরণে ও স্বল্প দুরুত্বের যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে ২০১০ সালে চীনের তাংশান রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ২০ জোড়া ডেমু ট্রেন ক্রয় করে। সে সময় ৪২৬ কোটি টাকায় ২০ জোড়া ডেমু ট্রেন ক্রয়ের এ প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে কেনা হয় ৬৫৪ কোটি টাকায়। অথচ প্রকল্প বাস্তাবয়নের কয়েক বছর পরই বহুল আলোচিত ডেমু ট্রেন সেবার পরিবর্তে রেলওয়ের গলার কাঁটায় পরিণত হয়।
রেলওয়ের প্রকৌশলী ও মেকানিকদের জন্য ডেমু সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তি হওয়ায় বিকল হওয়া ডেমু নিয়ে বিপাকে পড়ার পরও জিওবির অর্থায়নে সম্প্রতি ৬ ইউনিট বিশিষ্ট আরও ২ সেট বিশেষ ডেমু ট্রেন ক্রয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রেলওয়ে। যা কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ওই রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের সেবা দানের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে চলাচল করবে বলে জানায় রেলওয়ে কর্মকর্তারা।
সেবা খাত হিসাবে দাবি করলেও বহির্বিশ্বের মতো লাভজনক অবস্থানে নেই বাংলাদেশ রেওলয়ে। এরপরও ডেমু ট্রেনের মাধ্যমে লোকসানের পরিমাণ বাড়ানোর কারণ অজানাই রয়ে গেলো। নিয়ম না মেনেই ডেমু চালানোর কারণে প্রায় প্রতিদিনই লোকোশেডে যোগ হচ্ছে ডেমু ট্রেন।
সংশ্লিষ্ট মেকানিকরা বলছেন, ডেমুর প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত না হওয়ায় মেরামত কাজ করতে পারছেন না তারা। সম্পূর্ণ নতুন একটি প্রযুক্তি আমদানি করা হয়েছে যা নিয়ে তাদের কেউই প্রশিক্ষিত নন। এদিকে, দেশীয় প্রযুক্তিতে কোনো রকমে মেরামত কাজ চললেও ডেমুর মূল সমস্যা সারাতে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ। এমনকি ডেমুর কোনো যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না বাংলাদেশে।
কমলাপুর ডেমু মেরামত ওয়ার্কশপের ইনচার্জ আবু সাঈদ বিডি২৪লাইভকে বলেন, ডেমু মেরামতের এসব কাজগুলো আমরা ভালোভাবে করতে পারি না। মেরামত করতে যেসব মালামালের দরকার সেসব মালের কোন জোগান আমাদের নেই। তাই আমরা প্রপারলি কাজ করতে পারছি না।
ডেমু সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমস্যার সমাধান করতে হলে ডেমু ক্রয়ের আগেই আমাদেকে মেরামতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে যেসব ডেমু ট্রেনগুলো বিকল হয়ে পড়ে আছে সেগুলো মেরামতের জন্য চায়না থেকে দক্ষ মেকানিক এনে এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে এগুলোকে সারাতে হবে।
রেলের কর্মকর্তারাও বলছেন, নষ্ট হওয়া ডেমু দেশে ঠিক করার মতো ব্যবস্থা নেই। চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত বেশিরভাগ ডেমুর ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে করছেন রেলের প্রকৌশলীরা।
তারা বলছেন, সাধারণত রেলের ইঞ্জিনের গড় আয়ু থাকে ২৫ বছর। আর বগির ক্ষেত্রে তা ২০ বছর। মেরামত করে ইঞ্জিন ও বগি আরও কয়েক বছর চালানো যায়। ডেমু ট্রেনের দুই দিকে দুটি ইঞ্জিন এবং মাঝখানে একটি বগি থাকে। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিনেও যাত্রী বহন করা যায়। অর্থাৎ, দুই ইঞ্জিন এবং এক বগি নিয়েই এক সেট ডেমু। সব মিলিয়ে একসেট ডেমুতে বসে ১৪৯ জন এবং দাড়িয়ে ১৫১ জন যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। এর বেশি যাত্রী উঠলেই ডেমু অকেজো হয়ে যায়। তাই প্রথম দিকে গুনে গুনে ডেমুতে যাত্রী ওঠাতেন রেলের কর্মীরা। যা কিছুদিন পর আর করা হয় না।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেনে করে দ্রুত শহরতলির মানুষ যাতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের মতো বড় শহরে প্রতিদিন যাতায়াত করতে পারে, সেই লক্ষ্যে ডেমু আমদানি করা হয়েছিল। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে প্রথম ডেমু ট্রেন চালু করা হয়। ডেমু স্বল্প দূরত্বে (সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার) চলাচলের উপযোগী হলেও ২০১৩ সালের মে মাসেই চট্টগ্রাম-লাকসাম রেলপথে এই ট্রেনে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। এই পথের দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। পর্যায়ক্রমে রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলেও (পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল এ দুই ভাগে বিভক্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে) ডেমু চালু করা হয়।
রেলের কর্মকর্তারা বলেন, ডেমু যেসব পথে চলছে, তার মধ্যে ঢাকা-জয়দেবপুরের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার, ঢাকা-টঙ্গী ২২ কিলোমিটার, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ৯০ কিলোমিটার, সিলেট-আখাউড়া ১৭৬ কিলোমিটার, ঢাকা-আখাউড়া ১২০ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা ১৫৫ কিলোমিটার, নোয়াখালী-লাকসাম ৪৮ কিলোমিটার, লাকসাম-চাঁদপুর ৪৯ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ৩৭ কিলোমিটার, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট ৭১ কিলোমিটার এবং পার্বতীপুর-পঞ্চগড়ের দূরত্ব ১৩২ কিলোমিটার।
রেলের প্রকৌশলীরা জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় এক বিভাগীয় শহর থেকে অন্য বিভাগীয় শহরে ডেমু চালানো হয়। কিন্তু একটানা দীর্ঘ পথ চালানোর জন্য ডেমু উপযুক্ত নয়। যে কারণে গত বছরের শেষের দিকে একে একে ১১ সেট ডেমু বিকল হয়ে যায়।
আগের ২০ সেট ডেমুর অধিকাংশই বিকল হয়ে পড়ে আছে, তাছাড়া যে লক্ষ্যে ডেমু ক্রয় করা হয়েছে কার্যত তা হচ্ছে না, তাও কেন পুনরায় আরও ২ সেট ডেমু ক্রয় করা হচ্চে এমন প্রশ্নের জবাবে রেলওয়ের অর্থনীতিবিদ এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বিডি২৪লাইভকে বলেন, আগের ডেমুগুলো ছিলো মিটারগেজ আর বর্তমানে যে ২ সেট ক্রয়ের পরিকল্পনা করা হয়ে তা ব্রডগেজ এসি। আগেরগুলোর সাথে এবারের ডেমুর অনেকটাই প্রার্থক্য রয়েছে। বিকল হয়ে ওয়ার্কশপে পড়ে থাকা ডেমু কি আদৌ সারানো যাবে এমন কথা বলে শেষ করার আগেই তিনি বলেন, এসব নিয়ে রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ কথা বলবে।
বর্তমানে কত সেট ডেমু বিকল অবস্থায় আছে এবং তা আদৌ সারানো সম্ভব কিনা জানতে চাইলে রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) এস এম মুরাদ বলেন, এটা আমার মুখস্ত নেই। এটা ডিবিশনে কথা বলতে হবে।
ডেমু প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক এ নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
বিডি২৪লাইভ/আরআই