আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ায় ‘এনপিএস’
এনপিএস দেখতে চা পাতার মতো। ‘গ্রিন টি’র আড়ালে বাংলাদেশে আমদানি করা হচ্ছে এই মাদক
বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই সহজলভ্য মাদকদ্রব্যের তালিকায় রয়েছে গাঁজা। গাঁজার পর আসে হেরোইন, এটি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এ দেশে আসতে শুরু করে। আর ফেন্সিডিল আসে ৯০–এর দশকে ভারত থেকে। এরপর সর্বগ্রাসী মাদক ইয়াবা, যেটি নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে থাবা দেয়। তবে সব ছাপিয়ে এখন আলোচনায় ‘এনপিএস’, এটি বাংলাদেশে নতুন মাদক। বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা বলছেন, এনপিএস ইয়াবার চেয়েও বেশি আগ্রাসী ও ক্ষতিকারক। এটি সেবনকারীর মৃত্যু ঘটনাতে পারে। বাড়িয়ে দেয় আত্মহত্যার প্রবণতাও।
‘এনপিএস’এর পূর্ণরূপ ‘নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস’। বাংলাদেশে নতুন মনে হলেও বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে এটি পরিচিত। জাতিসংঘ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে মাদক সেবনপ্রবণ ৮০টি দেশ এবং অঞ্চলে জরিপ করে ৭০টিতেই এনপিএস’র উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটিও তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ‘এনপিএস’ মাদক সেবনকারী একসময় আত্মহননের পথই বেছে নেন।
ইউএনওডিসি’র কাছে ১০৩টি রাষ্ট্র তাদের দেশে এনপিএস’র অপব্যবহার ও সহজলভ্যতার কথা জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইউএনওডিসি ১৯৬১ সালের কনভেনশনের মাধ্যমে ১১৯টি এবং ১৯৭১ সালের কনভেনশনের মাধ্যমে ১১৫টি দেশসহ ২৩৪টি দেশে এনপিএস নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে গ্লোবাল মার্কেটে লাগামহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এনপিএস।
ইউএনওডিসি’র সংজ্ঞা অনুযায়ী এনপিএস একটি ডিজাইনার বা পরিকল্পক মাদক। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এটি বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তন করে উচ্চমাত্রার মাদকে রূপ দেয়া যায়। সংশ্লেষণ, সমন্বয় ও সিনথেটিকের মাধ্যমে এটিকে মাদকে রূপ দেয়া হয়।
এদিকে জনশক্তি রফতানি, ব্যবসা-বানিজ্য, ভ্রমণ, চিকিৎসকসহ অন্যান্য কারণে বাংলাদেশের মানুষের বিদেশ গমন ও বিদেশিদের এদেশে আগমনে বিদেশি কালচারের সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অবাধ তথ্যের আদান-প্রদান এবং আকাশ সংস্কৃতির কারণেও দেশের কিশোর ও যুবসমাজ বিদেশি সংস্কৃতির অনুকরণ করছে। কথিত স্মার্ট হওয়ার প্রবণতার জন্যও যুবসমাজ মাদকের দিকে ঝুঁকছে। ইয়াবার ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর প্রতিবেদন প্রকাশের ১০ বছরের মাথায় ইয়াবায় সয়লাব হয় দেশ। যে কারণে এনপিএস নিয়ে আগাম ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতে, এনপিএস নামে উদ্ভিদজাতীয় এই মাদক স্থানীয়ভাবে ‘খাত’ নামে পরিচিত। দেখতে অবিকল চা পাতার গুড়ার মতো। দেশে অপ্রচলিত হলেও ‘গ্রিন টি’র আড়ালে আমদানি করা হচ্ছে এনপিএস। ইয়াবার (মেথাএমফিটামিন) মতোই এটি স্টিমুলেন্ট ড্রাগ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, এনপিএস অপব্যবহারের পদার্থ, যা ১৯৬১ সালের প্রচলিত মাদক আইন অথবা ১৯৭১ সালের ওষুধ আইনে নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। যদিও জনস্বাস্থ্যের জন্য এটা প্রচণ্ড রকমের ক্ষতিকর। পণ্যটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০ এর ‘খ’ তফসিলে ২ নং ক্রমিকভুক্ত, যা একই আইনের ১৯ (১) টেবিলের ১০ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মাদকপ্রবণ দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এনপিএস মাদক তৈরি হতে পারে। তবে গত শুক্রবারই (৩১ আগস্ট) প্রথম এর অস্তিত্ব মিলেছে। ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা থেকে জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি ঢাকায় এনপিএসের একটি চালান পাঠান। এ দেশে নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে চালানটি পাঠানো হয়। চালানটি কয়েক দিন আগে ইথিওপিয়া থেকে কয়েকটি দেশ ঘুরে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসে।
এরপরই দুই দফার অভিযানে বিমানবন্দর ও শান্তিনগর প্লাজা থেকে মোট ৮৬১ কেজি এনপিএস-সহ মো. নাজিম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার হওয়া এনপিএস’র আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ২৯ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা।
এনপিএস’র ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে নজরুল ইসলাম শিকদার বলেন, এনপিএস মূলত চিবিয়ে বা পানিতে গুলিয়ে চায়ের মতো খাওয়া হয়। খাওয়ার পর ইয়াবার মতোই ক্লান্তি না আসা, ঘুম না হওয়াসহ শারীরিক বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এনপিএস আসক্ত ব্যক্তি মানসিক বৈকল্যে ভোগেন। সামাজিকভাবে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেন। কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। বেঁচে থাকা তার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, এনপিএস তৈরির উপাদানগুলো বৈধ হলেও এর ভয়াবহতার কারণে অনেক দেশ স্থায়ীভাবে এনপিএস নিয়ন্ত্রণ করছে, অনেক দেশ অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধও করছে। এনপিএসের ব্যবহার ব্যাপকমাত্রা পেলে যুবসমাজ ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রথম যখন এনপিএস’র অস্তিত্য পাওয়া গেলো তখন একদিনেই মিললো ৮৬১ কেজি। এটি কাকতালীয় নয়। এ থেকে এটা স্পষ্ট যে, এনপিএস আরও আগে থেকে আসছে।
এই ওষুধ প্রযুক্তিবিদ বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হলো সবকিছু আমলাতান্ত্রিকভাবে দেখি। মাদকের মাফিয়ারা এই এনপিএস নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। সয়লাব হবার আগেই এটা নির্মূল করতে হবে। কিন্তু আপনি যদি এনপিএস না বোঝেন কিংবা না চেনেন তবে তা সম্ভব না। সেজন্য মাদক কিংবা ওষুধ প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি, নতুন নতুন মাদক চিনতে অত্যাধুনিক ল্যাব তৈরি, যুগোপযোগী আইনও জরুরি। যাতে করে মাদক সংশ্লিষ্টরা ছাড় না পেয়ে যায়।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অপারেশনস ও গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক সৈয়দ তৌফিক উদ্দীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ইয়াবা সয়লাব হবার আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এরপরও ১০ বছরের মধ্যে ইয়াবায় সয়লাব হয়ে যায় দেশ, কারণ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৬ সালে আমরা এনপিএস নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করি। যদিও তখন এনপিএস’র অস্তিত্ব মেলেনি। তবে দুই বছরের মাথায় এর অস্তিত্ব মিললো। এবারও যদি ব্যবস্থা নেয়া না যায়, তবে ইয়াবার মতোই ছড়িয়ে পড়তে পারে এনপিএস। সুতরাং পরিচিতি ও প্রসারের আগেই এনপিএসকে নির্মূল করতে হবে।