বাসটা থামালে আমার পা বেঁচে যেত : রোজিনা
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর বনানীতে বাসের চাপায় পা হারানো রোজিনা আক্তার বলেছেন, অন্য একটি গাড়ির ধাক্কায় পড়ে যাওয়ার পর বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাস তার উপর দিয়ে চলে যায়, সে সময় বাসটি থামানো হলে তার এই পরিণতি হত না।
শুক্রবার রাতে বনানীতে ওই দুর্ঘটনার পর রোজিনার (২১) ডান পা উরু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। এখনও তিনি পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহের মেয়ে রোজিনা ছয় বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ঢাকায় সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজার বাসায় ১০ বছর ধরে কাজ করেন তিনি। মহাখালীতে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়িয়ে গুলশানের নিকেতনের বাসায় ফেরার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন রোজিনা।
শনিবার দুপুরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) জেনারেল ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে রোজিনা ওই দুঃসহ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “কয়েকজন রাস্তা পার হচ্ছিল, আমি রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটপাত থেকে নেমে মাত্র দুই পা দিয়েছি এমন সময় একটা গাড়ি সামনে এসে যায়। আমি ইশারা দেওয়ার পর গাড়িটা ব্রেক করে থামে। কিন্তু আমি যেই সামনে গেছি, গাড়িটা একটা বাড়ি দেয়। আমি তখন সামনের দিকে পড়ে গেছি। এরপরও বাসটা থামায় নাই। এত বড় বাসটা আমার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়।
“আমি যখন পড়ে গেছি, তখন বাসটা থামালে আমার পাটা বাঁচানো যেত,” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন রোজিনা।
দুর্ঘটনার সময় আশপাশে পুলিশসহ অনেকে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “দুইবার আমার উপর দিয়ে চাকা চলে গেছে। আমি শুধু বলছিলাম, আমাকে একটু হসপিটালে নিয়ে যান। এরপর আর কিছু জানি না। অনেক মানুষকে বলছি আমাকে একটু হসপিটালে নিয়ে যেতে। অনেক মানুষকে বলছি। সার্জেন্টও ছিল। কিন্তু ধরে নাই।”
পরে একজন লোক এসে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালের দিকে যাত্রা করে জানিয়ে রোজিনা বলেন, “যখন সেন্স আসে, তখন দেখি আমাকে তিন-চারজন সিএনজি করে নিয়ে যাচ্ছে।”
রাত ৯টার দিকে এই দুর্ঘটনার পর পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয় রোজিনাকে, সেখানেই রাত ১টায় অস্ত্রোপচার করে তার পা কেটে ফেলা হয়।
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত এই গৃহকর্মী বলেন, “আমি এখন কী করব? আমি তো আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারব না। আমার যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আমি তো আর আমার পাটা ফিরে পাব না।”
দুর্ঘটনার জন্য চালকদের শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে মন্তব্য করে রোজিনা বলেন, “ওদের কোনো শাস্তি হয় না। শাস্তি চেয়েও কোনো লাভ নাই। ছয় মাস, এক বছর জেল হয়, তারপর ওরা স্বাধীন মতো চলে। কোনো কিছু হয় না ওদের।”
বেপরোয়া চালকদের বিচার হলে সড়কে দুর্ঘটনা কমত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ওদের যদি কোনো কিছু হত, তাহলে একটা অ্যাক্সিডেন্টের আগে ওরা দশবার চিন্তা করত। ওদের বিচার চেয়েও কোনো লাভ নাই।”
এই মাসের শুরুর দিকেই কারওয়ানবাজারে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারানোর পর মারা যাওয়া কলেজছাত্র রাজীবের প্রসঙ্গ টেনে রোজিনা বলেন, “পত্রিকায় আমি দেখছি, রাজীব ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করছে। কিন্তু কোনো বিচার কি হইছে?”
মেয়ের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ময়মনসিংহ থেকে ছুটে এসেছেন রোজিনার বাবা মো. রসুল মিয়া। বাবাকে দেখার পর থেকেই নানাভাবে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন রোজিনা।
মেয়ের চিকিৎসার খরচ নিয়ে জানতে চাইলে রসুল মিয়া বলেন, “খরচ দিলে তো অনেকেই দিতে পারে। স্যার (ইশতিয়াক রেজা) দিতে পারে, আপনারাও দিতে পারেন। কিন্তু ওর জীবনটা কেমনে চলব? ওই তো ইনকাম করত। ওর বিয়ে হয়ে বাচ্চা-কাচ্চা হলে তো তাদের সে-ই চালাত। কিন্তু এখন তো আর কিছু করতে পারবে না।”
মাসে ছয় হাজার টাকা করে বেতন পেতেন রোজিনা। তার ছোট বোন তানজিলা নিকেতনে আরেকটি বাসায় কাজ করেন।
তিনি বলেন, শুক্রবার বিকালে বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়েন রোজিনা।
“পা কেটে ফেলার সময় অনেক কাঁদছে। ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করার সময়ও চিৎকার করে কাঁদছিল।”
হাসপাতালে রোজিনাকে দেখতে আসা সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজার বোন তাসনিম বলেন, “গতকাল দুপুরেও আমি ভাইয়ার বাসায় ছিলাম। ও কত মজা করল। তারপর ভাবীকে বলল- ঘুরতে যাবে, পহেলা বৈশাখে কোথাও যায়নি। কিন্তু এতো বড় একট দুর্ঘটনা ঘটে যাবে চিন্তাই করিনি। মেয়েটার বিয়েও হয়নি। খুব খারাপ লাগছে।”
রোজিনার চিকিৎসার সব খরচ দিতে চেয়েছেন সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজা।
তিনি বলেন, “রোজিনা আমাদের বাসায় আছে অনেক বছর ধরে। ওর চিকিৎসার সব খরচসহ কৃত্রিম পা লাগানোর সব ব্যবস্থা আমি করব। ও আমার পরিবারের সদস্য। আমার বাসায়ই ও থাকবে।”
রোজিনা এখনও শঙ্কামুক্ত নয় জানিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পরিচালক গণি মোল্লা বলেন, “ওর অনেক রক্ত পড়েছে। তবে সে খেয়েছে, কথা বলেছে আমাদের সাথে। আশা করি খুব দ্রুত ভালো হয়ে যাবে।” বিডিনিউজ