বুধবার, ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ইং ১৬ই ফাল্গুন, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্ত কাছিম প্রজননে বিশ্বসেরা বাংলাদেশ

ডেস্ক রিপোর্ট : কাছিমের অতি বিপন্ন প্রজাতি বাটাগুর বাসকা প্রজননে বিশ্বসেরা স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গতকাল ওয়ার্ল্ড অ্যানিমেল নিউজ লেটারে এমন তথ্য জানানো হয়। বাটাগুর বাসকা একটি বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ। এর বৈজ্ঞানিক নাম বাটাগুর বাসকা এবং ইংরেজি নাম নর্দার্ন রিভার টেরাপিন। এ প্রজাতির বংশবিস্তারে ‘প্রজেক্ট বাটাগুর’-এর কার্যক্রম চলছে গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এবং সুন্দরবনের করমজলে। ডলফিন ছাড়াও কারিনাম নামের একটি এনজিও বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ বাটাগুর বাসকা নিয়ে ২০১০ সাল থেকে প্রজননের কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ বন বিভাগের সহযোগিতায় গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে বাটাগুর বাসকা প্রকল্প শুরু হয়। এরপর প্রকল্প এলাকায় গবেষণা করার জন্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।

বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ বাটাগুর বাসকার গবেষণার কাজটি সম্পন্ন করার জন্য হাতে গোনা দু-একটি সংস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ বন বিভাগ গবেষণার জন্য একটি প্রকল্পও প্রণয়ন করেছে। কাছিমের বিভিন্ন প্রজাতি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণার পথিকৃৎ অস্ট্রিয়ার টারটাল আইল্যান্ডের প্রধান বিজ্ঞানী ড. পিটার প্রাসাগের গবেষণা প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়া টিএসএ, অস্ট্রিয়ার জু ভিয়েনা এবং বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করছে বাংলাদেশের প্রজেক্টে। মূলত বিদেশি অর্থায়নেই বাটাগুর বাসকার প্রজনন ও সংরক্ষণের জন্য গবেষণা কার্যকম চলছে পুরোদমে। গবেষণার প্রয়োজনে গাজীপুরের ভাওয়াল উদ্যানে কচ্ছপ গবেষণা ও বংশবিস্তারের জন্য স্যান্ডবিচ তৈরি করা হয়। এরপর সেখানে কচ্ছপ ডিম পাড়ে। এ প্রজেক্টে দুটি পুকুর রয়েছে। একটি পুকুর বন বিভাগ আগেই খনন করেছিল কুমির প্রজননের জন্য। প্রকল্পের অর্থায়নে আরেকটি পুকুর পুনঃখনন করা হয়। এ পুকুর দুটিতে বাটাগুর বাসকা প্রজননের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। আরও রয়েছে হ্যাচারি, যেখানে বাটাগুর বাসকা কচ্ছপের বাচ্চাগুলোকে রেখে পরিচর্যা করা হচ্ছে।

বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ছাড়াও বন বিভাগের বর্ধিত আরেকটি প্রজেক্ট রয়েছে সুন্দরবনের করমজলে। করমজলে গবেষণার জন্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের গবেষণা কেন্দ্র থেকেই বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ পাঠানো হয়। ওখানেও এ কচ্ছপ বংশবিস্তারের কাজটি পুরোদমে চলছে। এ গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানী ড. পিটার প্রাসাগ বছরে দুই থেকে তিনবার বাংলাদেশে এসে প্রকল্প দুটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছেন। ২০১০ সালে তিনটা স্ত্রী ও পাঁচটা বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে। এরপর বৃহত্তর নোয়াখালী ও খুলনা থেকে এ কচ্ছপগুলো সংগ্রহ করা হয়। ড. এস এম এ রশীদ, ভারতের বিজ্ঞানী রুপালি ঘোষ এবং ড. পিটার প্রাসাগ সারা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল ঘুরে এসব কচ্ছপ সংগ্রহ করেন। বর্তমানে গাজীপুরের এ প্রজেক্টে রয়েছে ১৯টি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ। অন্যদিকে সাতটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী বাটাগুর বাসকা কচ্ছপ দিয়ে গবেষণা চলছে সুন্দরবনের করমজলে। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে বর্তমানে ব্রিডিংয়ে রয়েছে চারটি স্ত্রী ও তিনটি পুরুষ।

করমজলে ব্রিডিংয়ে রয়েছে চারটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী বাটাগুর বাসকা। প্রকল্প কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ এ সম্পর্কে বলেন, ‘২০১৬ সালে আলাদাভাবে স্ত্রী ও পুরুষ কচ্ছপ একত্রে রেখে প্রজননের চেষ্টা করি। তবে সেই চেষ্টা আমাদের সফলতার মুখ দেখাতে পারেনি। ছয়টি জোড়ার মধ্যে আমরা মাত্র দুটি জোড়া থেকে ডিম পেয়েছি। এদের মধ্যে একটি জোড়ার ডিমের অবস্থা ভালো ছিল না। আর অন্য জোড়াগুলো ডিম প্রজননে অক্ষম ছিল। বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ নিয়ে তথ্য হলো, দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্ত্রী কচ্ছপ তার শরীরে বীর্য ধারণ করে রাখতে পারে। ডিম দেওয়ার সময় স্ত্রী কাছিম সঙ্গমের জন্য পুরুষ কচ্ছপ না পেলে তার দেহে সঞ্চিত বীর্য ব্যবহার করে বংশবিস্তার করতে পারে। এ প্রজাতির কচ্ছপ বালুতে গর্ত করে ডিম পাড়ে। ওরা একবার যেখানে ডিম পাড়ে পরেরবারও সেখানেই ডিম পাড়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়া গবেষণা কেন্দ্রে ব্রিডিংয়ের জন্য বালুভর্তি ট্যাংকে সাতটি ডিম এবং স্যান্ডবিচে আটটি ডিম রাখা হয়। এভাবে ওই বছর প্রথম বাসকার বাচ্চা হয়। সাধারণত এই প্রজাতির কচ্ছপ ডিম পাড়ার ৬০ দিন পর বাচ্চা ফোটে। বাচ্চাগুলো জন্ম নেওয়ার পর নিজেরাই বালু থেকে বের হয়ে আসে।’

বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ মূলত নদীর নাব্যতা রক্ষা করে। এ ছাড়া পুকুরে যদি বাটাগুর বাসকা থাকে তাহলে পুকুরের পানি পরিষ্কার থাকে। কাছিমের ডিম দুই ধরনের হয়। গোলাকার ও লম্বাকৃতি। আগে বাংলাদেশে কাছিম নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। এই কচ্ছপের ডিম ও মাংস সুস্বাদুও বটে। কচ্ছপের মাংসে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে। এ ছাড়া কচ্ছপের চর্বি সাবান বানাতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে কচ্ছপ সম্পর্কে এক ধরনের ভুল ধারণা রয়েছে, পুকুরে কচ্ছপ থাকলে সে সেই পুকুরের মাছ খেয়ে সাবাড় করে দেয়। আসলে কচ্ছপ পুকুরে মাছের সঙ্গে সাঁতরে পেরে ওঠে না। সব প্রজাতির কচ্ছপ মাছ খায় না। বাটাগুর বাসকাও মাছ খায় না। এরা তৃণভোজী। কলমি এদের প্রিয় খাবার। চিত্রা নামের এক প্রজাতির কাছিম রয়েছে। এরা খুব ধূর্ত প্রকৃতির হয়। এরা দ্রুতই মাছ ধরতে পারে। তাই এই প্রজাতির কাছিম পুকুরে থাকলে মাছ চাষ ব্যাহত হতে পারে। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Print Friendly, PDF & Email