রোহিঙ্গা নিপীড়নের শতভাগ দায় সু চির: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
---
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে রাখাইন পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হলেও শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকটের সব দায় সেখানকার ক্ষমতাসীন ডি-ফ্যাক্টো সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির। ড. ইউনূস মনে করেন, রাখাইনের সেনা নিপীড়নকে সু চি অনুমোদন ও বৈধতা দিয়েছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস মন্তব্য করেন, সু চি যদি সেনাবাহিনীর চাপেই কোনও ভূমিকা নিতে না পারেন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত।
আল জাজিরার ‘আপ ফ্রন্ট’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকার রোহিঙ্গা সংকট এবং তা নিরসনের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন ড. ইউনূস। সু চির প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, ‘তিনি (সু চি) শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বব্যাপী তিনি তার একটি ইমেজ তৈরি করেছেন, সারা বিশ্ব তাকে সম্মান করে। তবে পুরোপুরি উল্টে গেছেন তিনি। বিশ্ব এখন তার ভিন্ন রূপ দেখছে। সু চি নিজ দেশের মানুষের গণহত্যায় নিজের নাম জড়াচ্ছেন।’
রোহিঙ্গা নাগরিকত্বের প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের যে অঞ্চলে রোহিঙ্গা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে, আমিও সেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষ। এই রোহিঙ্গারা সেখানে জন্মগ্রহণ করেছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেখানে অবস্থান করছে। দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, তখন তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দেশটির নাগরিক হয়ে গেছে। তারা দেশটির রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে, নিজেদের প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠিয়েছে, তাদের প্রতিনিধি মন্ত্রিসভায়ও স্থান পেয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা বলল, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো।’
সু চি মিয়ানমারের নির্বাচিত নেত্রী হওয়া সত্ত্বেও দেশটির মূল চালিকা শক্তি এখনো সেনাবাহিনীর হাতেই। সেনাবাহিনীই সব করছে। সু চিকে কতোটুকু দোষ দেওয়া যায়। আলজাজিরার এমন অবস্থানের বিপরীতে ড ইউনূস বলেন, ‘আমি তাকেই (সু চি) শতভাগ দায়ী করব। কারণ তিনিই তো নেত্রী। তিনি বলতে পারেন, সেনাবাহিনী তাকে চাপে রেখেছে, তাহলে তো তার পদত্যাগ করা উচিত। কারণ তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না।’
সু চিকে সেনাবাহিনীর মদদদাতা আখ্যা দিয়েছেন ড. ইউনূস। বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের নাগরিক। অথচ তিনি নিজ মুখে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা নির্যাতনের সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা কেন বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যাকে অস্বীকার করছেন তিনি, নির্যাতনের অভিযোগকে তিনি মিথ্যা সংবাদ বলছেন। তিনি সব দায় নিজের ঘাড়ে নিয়েছেন। তাই আপনি শুধু সেনাবাহিনীর ওপরই দায় চাপাতে পারেন না। এ দায় সম্পূর্ণই সু চির। এ সমস্যার জন্য সু চি দায়ী। তাকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির কোনও অবস্থান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেলে আবারও সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে চলে যাবে কিনা, এমন শঙ্কার বিপরীতে ড. ইউনূস বলেন, ‘তিনি নেতা। তার যা বলা উচিত, সেটি যদি তিনি বলতে না পারেন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত। নেতাদেরকে তার জনগণের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে।’
সর্বশেষ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সু চির সাথে এখনও ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা হয়নি জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘তার সঙ্গে আমার বিভিন্ন সময় দেখা হয়েছে। মিয়ানমারের সর্বশেষ নির্বাচনের আগেও তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তখন আমি তাকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বলেছিলাম। উত্তরে তিনি আমাকে বলেছেন, সেনাবাহিনী নিয়ে আমাকে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। আমি তাই কিছু বলতে পারছি না। তবে নির্বাচিত হলে আমি অবশ্যই রোহিঙ্গাদের স্বার্থে পদক্ষেপ নেব’।
যদি সু চির সাথে সরাসরি কথা হয়, তাহলে তাকে কী বলতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘তাকে বলতাম যে আপনার তো অবস্থান নেওয়া উচিত। বছরের পর বছর ধরে আপনি আপনার যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন, সেটি রক্ষা করতে হবে। আপনি মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার একজন নেত্রী হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছেন। আপনি বছরের পর বছর ধরে গৃহবন্দি ছিলেন। অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন। আপনার একটা নীতি আছে, একটা মূল্যবোধ আছে। এখন সেসব মূল্যবোধের কী হলো? এটা কী তাইলে ক্ষমতায় থাকার জন্য বাকি সবার থেকে আলাদা হয়ে শুধু সেনাবাহিনীর সাথে থাকা? সেনাবাহিনী আপনাকে কী করবে? আবার গৃহবন্দি করে রাখবে?’ সু চি আসলে নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য কিনা, এ প্রশ্নের উত্তরে ইউনূস বলেন, যদি নোবেল কমিটির সামনে এসব সংবাদ থাকতো, আমি নিশ্চিত তারা শান্তি পুরস্কারের জন্য সু চিকে বিবেচনা করত না।
ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ কীভাবে এ বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে বা কতদিন এভাবে আশ্রয় দিতে পারবে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়। এটা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার বিষয়ও। ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। পুরো অঞ্চলটি খুব শিগগিরই সন্ত্রাসবাদের আখড়া হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্কও এখানে কাজ করা শুরু করবে। ফলে এটা বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, পুরো অঞ্চলের জন্যই হবে ভয়াবহ। একসময় সবকিছু মিলিয়ে একটা বিস্ফোরণ হবে। আমি বলতে চাই, এসব ঘটার আগেই এ সমস্যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করতে হবে।’
হেফাজতে ইসলাম রোহিঙ্গা স্রোত ব্যবহার করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছে উল্লেখ করে আল জাজিজার পক্ষে মেহেদি হাসান হেফাজতে ইসলাম নিয়ে ড. ইউনূসের অবস্থান জানতে চান। জবাবে ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পুরো অঞ্চলই এতে জড়িয়ে পড়বে। ভারত ও পাকিস্তানও এতে জড়াবে, সব জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোও এতে জড়াবে। কত সংখ্যক দেশ এতে জড়াবে, তা শুধু সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারবে।’
আল জাজিরার সাংবাদিক মেহেদী ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করেন যে রোহিঙ্গা সংকটে তিনি মিয়ানমার-বাংলাদেশ দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন কিনা? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘যে কোনো কিছুই হতে পারে। আমরা কিছু বলতে পারছি না। কারণ, রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে, বা রোহিঙ্গাদের নাম ব্যবহার করেও কেউ কিছু করতে পারে। এটি যে কোনো দিকেই মোড় নিতে পারে। সন্ত্রাসবাদ জন্ম নিতে পারে হতাশা থেকে। সর্বশেষ রোহিঙ্গা সঙ্কটে অসংখ্য নারী ও শিশু নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসব শিশুরা বড় হবে। কে তাদের শিক্ষা দেবে? কে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে? তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?’ প্রশ্ন রাখেন ইউনূস।