g যে কারণে ভারত ভাগ করতে রাজি হলেন নেহেরু | AmaderBrahmanbaria.Com – আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া

শুক্রবার, ৩রা নভেম্বর, ২০১৭ ইং ১৯শে কার্তিক, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

যে কারণে ভারত ভাগ করতে রাজি হলেন নেহেরু

AmaderBrahmanbaria.COM
আগস্ট ৩০, ২০১৭

---

নিজস্ব প্রতিবেদক :ভারত ছাড়তে হবে- একথা ব্রিটিশরা ১৯৪৫ সালের দিকে পুরোপুরি বুঝে গিয়েছিল। সেসময় ১৯৪৮ সালের ৩০ জুনের আগেই ভারতবর্ষের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৪৬ সালের মার্চে কেবিনেট মিশন নামে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে।

এর কয়েক মাস পরই জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও মুসলিম লীগ প্রথমে তাতে যোগ দেয়নি। অনেক আলোচনার পর ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেয়।

এরই মধ্যে কলকাতা এবং নোয়াখালীসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। সে প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ নতুন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে আসেন। তখন থেকে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিতে থাকে।

ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগ করা কেবিনেট মিশনের লক্ষ্য ছিল পুরো ভারতবর্ষকে অখণ্ড রেখে বিভিন্ন অঞ্চলে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেয়ার মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন নতুন ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর ইংরেজদের মাথায় ভিন্ন চিন্তাও আসা শুরু করে।

লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে তখন অনেকগুলো বৈঠক করেন ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির তখনকার প্রেসিডেন্ট মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। লর্ড মাউন্টব্যাটেন মাওলানা আজাদকে বলেছিলেন, ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু, তার আগে ভারতবর্ষে চলমান হিন্দু-মুসলমান সংঘাত বন্ধের জন্য একটি পদক্ষেপ নিতে হবে।

মাওলানা আজাদ মাউন্টব্যাটেনকে জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যকার মতপার্থক্য অনেক কমে এসেছে।

তখন ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন ভারত ভাগের ক্ষেত্রে বাংলা এবং আসামকে একত্রে রেখেছিল। কিন্তু কংগ্রেস এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে। আসাম এবং বাংলা একসাথে থাকবে কি-না এ নিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য শুরু হয়।

 

দুই পক্ষের মতপার্থক্য এমন একটি জায়গায় পৌঁছায়, তখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়ে পড়লো। মাওলানা আজাদ প্রস্তাব করেছিলেন এ বিষয়টি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ওপর ছেড়ে দিতে। কিন্তু তখনকার কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল তাতে রাজি হলেন না। তারা এ বিষয়টিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মধ্যস্থতা চাননি।

ইতিমধ্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছিল। কলকাতা দাঙ্গার পর হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী ও বিহারে। একদিকে যখন সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে প্রশাসন তখন একটি গা ছাড়া ভাব নিয়েছে। প্রশাসনে থাকা ইউরোপীয়রা তখন কাজে মন দিচ্ছে না। কারণ, তারা বুঝতে পারছিল, যেকোনো সময় ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, তাই তারা শুধু দিন গুণছিল।

ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশরা যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দিয়েছিল, সেখানে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে কিছু দপ্তর ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেল এবং অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানকে।

কয়েকদিনের মধ্যেই কংগ্রেস নেতারা বুঝতে পারলেন, মুসলিম লীগের হাতে অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া বিরাট ভুল হয়েছে। কারণ লিয়াকত আলী খানের অনুমোদন ছাড়া সরদার প্যাটেল একজন চাপরাশিও নিয়োগ দিতে পারছিলেন না। ফলে কংগ্রেস নেতাদের নেয়া সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো।

মাওলানা আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী, কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেলের কারণেই এ পরিস্থিতির তৈরি হয়। কারণ, সরদার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিজ হাতে রেখে লিয়াকত আলী খানকে অর্থ দপ্তর দিয়েছিলেন।

এমন প্রেক্ষাপটে লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগ নিয়েছিলেন। র্নিবাহী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের সুযোগে তিনি ধীরে ধীরে পূর্ণ ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়ে নেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, একমাত্র ভারত বিভক্ত হলে এর সমাধান হতে পারে।

 

মাওলানা আজাদ লিখেছেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন এবং বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের মনে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন করেছিলেন। আর মাউন্টব্যাটেনের এ ধারণা ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেল সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারতবর্ষ ভাগ করার জন্য সরদার প্যাটেল আগে থেকেই মানসিকভাবে অর্ধেক তৈরি ছিলেন। প্যাটেল ধরে নিয়েছিলেন, মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করা যাবে না। সরদার প্যাটেল এক পর্যায়ে জনসম্মুখে বলেই ফেললেন, মুসলিম লীগের হাত থেকে মুক্তির জন্য তিনি ভারতবর্ষ ভাগ করতেও রাজি। একথা বলা অত্যুক্তি হবে না, সরদার প্যাটেলই ছিলেন ভারতবর্ষ ভাগের স্থপতি।

ভারতবর্ষ বিভক্ত করার ফর্মুলা বিষয়ে সরদার প্যাটেল মনস্থির করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন মনোযোগ দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহেরুর দিকে। এ ধরনের ফর্মুলার কথা শুনে প্রথমে নেহেরু খুবই রাগান্বিত হন। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলাল নেহেরুকে ভারতবর্ষ ভাগ করার বিষয়ে ক্রমাগত বোঝাতে থাকেন। এ বিষয়ে নেহেরুর রাগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত মাউন্টব্যাটেন তাঁর তৎপরতা চালিয়ে গেছেন।

কিন্তু ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু শেষ পর্যন্ত কিভাবে রাজি হলেন?

মাওলানা আজাদ মনে করেন, এর দুটি কারণ আছে। প্রথমত, জওহরলাল নেহেরুকে রাজি করানোর বিষয়ে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রীর একটি বড় প্রভাব ছিল। লেডি মাউন্টব্যাটেন ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। এছাড়া, তার মধ্যে আকর্ষণীয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছিল; যার মাধ্যমে তিনি অন্যদের আকৃষ্ট করতে পারতো। লেডি মাউন্টব্যাটেন তার স্বামীকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক সময় যারা প্রথমে তার স্বামীর কাজের সাথে একমত হতে পারতেন না, তাদের কাছে স্বামীর চিন্তা-ভাবনা পৌঁছে দিয়ে তাদের সম্মতি আদায় করতেন।

ভারত ভাগ করার পেছনে নেহেরুর রাজি হওয়ার আরেকটি কারণ ছিলেন কৃষ্ণ মেনন। ভারতীয় এ ব্যক্তি ১৯২০’র দশক থেকে লন্ডনে বসবাস করতেন। কৃষ্ণ মেনন ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর একজন বড় ভক্ত এবং নেহেরুও কৃষ্ণ মেননকে খুব পছন্দ করতেন।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমন্বয়ে ভারতবর্ষে যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয় তখন কৃষ্ণ মেননকে লন্ডনে হাই কমিশনার নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন নেহেরু। কিন্তু কৃষ্ণ মেননের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের আপত্তি ছিল। কারণ, ১৯৩০’র দশকের প্রথম দিকে ব্রিটেনের লেবার পার্টির একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কৃষ্ণ মেনন ভারত সফর করেছিলেন।

১৯৪৬ সালের দিকে কৃষ্ণ মেনন যখন আবার ভারতে আসেন তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন বুঝতে পেরেছিলেন, ভারত ভাগ করার বিষয়ে তার মাধ্যমে নেহেরুকে রাজি করানো যাবে।

মাওলানা আজাদ যখন জানতে পারলেন, ভারত ভাগ করার বিষয়ে জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার প্যাটেল মোটামুটি একমত হয়েছে তখন তিনি ভীষণ হতাশ হয়েছিলেন। মাওলানা আজাদ মনে করতেন, ভারত বিভক্ত হলে সেটি শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়, পুরো ভারতের জন্যই খারাপ হবে। তাঁর দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের মূল সমস্যা ছিল অর্থনৈতিক। সাম্প্রদায়িক সমস্যা কোনো বড় সমস্যা না।

ভারত ভাগ করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিতে সরদার প্যাটেল এবং জওহরলাল নেহেরুকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মাওলানা আজাদ। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল এতটাই অনড় ছিলেন, তিনি অন্য কারো মতামত শুনতে মোটেই রাজি ছিলেন না।

সরদার প্যাটেলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মাওলানা আজাদ তাঁর বইতে লেখেন, ‘আমরা পছন্দ করি কিংবা না করি, ভারতবর্ষে দুটো জাতি আছে। হিন্দু এবং মুসলমানরা এক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। যখন দুই ভাই একসাথে থাকতে পারে না, তখন তারা আলাদা হয়ে যায়। তাদের পাওনা নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর তারা আবার বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু তাদের যদি একসাথে থাকতে বাধ্য করা হয় তাহলে তারা প্রতিদিন ঝগড়া করবে। প্রতিদিন মারামারি করার চেয়ে একবার বড় ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো।’

আজাদের বর্ণনায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয় তো ভারত ভাগ করার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, কিন্তু এখন সরদার প্যাটেল সে পতাকা বহন করছেন।

ভারত ভাগ করার বিষয়ে সরদার প্যাটেল যেভাবে প্রকাশ্যে কথা বলতেন, জওহরলাল নেহেরু সেভাবে বলতেন না। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী পরিষদে মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করতে গিয়ে নেহেরুর তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রতিদিনই ঝগড়া হতো। সেজন্য মাওলানা আজাদকে জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, ভারতবর্ষ ভাগ না করে কোনো উপায় নেই।

মাওলানা আজাদকে নেহেরু অনুরোধ করেন, তিনি যাতে ভারত ভাগের বিরোধিতা না করেন এবং বাস্তবতা মেনে নেন। নেহেরু এবং সরদার প্যাটেলের এ অবস্থানের কারণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর পাকিস্তান সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে আরো জোরালো অবস্থান নিলেন।

জওহরলাল নেহেরুকে সতর্ক করে মাওলানা আজাদ বলেছিলেন, ‘আমরা যদি ভারত ভাগ করার বিষয়ে একমত হই তাহলে ইতিহাস কোনোদিনও আমাদের ক্ষমা করবে না।’

সরদার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহেরুকে বোঝাতে ব্যর্থ হওয়ার পর মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) ছিলেন মাওলানা আজাদের শেষ ভরসা। একদিন তার সাথে দেখা করতে গেলে মাওলানা আজাদকে গান্ধী বলেন, ‘ভারত ভাগের বিষয়টি এখন বড় একটি ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে বল্লবভাই (সরদার প্যাটেল) এবং জওহরলাল আত্নসমর্পণ করেছে। আপনি এখন কী করবেন? আপনি কি আমার পাশে থাকবেন নাকি আপনিও মত পরিবর্তন করেছেন? কংগ্রেস যদি ভারত ভাগের প্রস্তাব মেনে নেয় তাহলে সেটা আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে হতে হবে। আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন ভারতবর্ষ ভাগ মানব না।’

কয়েকদিন পর গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে দেখা করলেন। এরপর সরদার প্যাটেল গান্ধীর সাথে দেখা করে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করলেন। সে আলোচনার বিষয়বস্তু জানা যায়নি। কিন্তু এরপর যখন মাওলানা আজাদ গান্ধীর সাথে দেখা করলেন, তখন বিস্ময়ে হতবাক হলেন মাওলানা আজাদ। কারণ, ভারত ভাগ করার ফমুর্লা নিয়ে গান্ধীর আগের অবস্থান বদলে গেছে। তিনি ভারত বিভক্তি সমর্থন না করলেও, আগের মতো জোরালো বিরোধিতাও করছেন না।

গান্ধীর এ অবস্থান দেখে হতাশ হয়েছিলেন মাওলানা আজাদ। তবে গান্ধী জানালেন, তিনি প্রস্তাব করেছেন যাতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সরকার গঠন করে এবং তাঁর পছন্দমতো ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা তৈরি করে। এ বিষয়টি গান্ধী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে তুলে ধরেন এবং মাউন্টব্যাটেন তাতে রাজি হয়েছেন।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন মাওলানা আজাদকে বলেছিলেন, গান্ধীর প্রস্তাব যদি কংগ্রেস মেনে নেয় তাহলে ভারত বিভক্তি এড়ানো যেতে পারে। কিন্তু জওহরলাল নেহেরু ও সরদার প্যাটেল গান্ধীর প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা দুজনে মিলে গান্ধীকে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। তখন গান্ধী বলেন, ভারতবর্ষ বিভক্তি অনিবার্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কিভাবে ভাগ হবে।

মাওলানা আজাদ রাজি না থাকলেও ভারত ভাগ করার বিষয়ে কংগ্রেসের বাকি নেতৃত্ব সেটি গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারপরও মাওলানা আজাদ তাঁর শেষ চেষ্টা হিসেবে গান্ধীকে আবারো বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি গান্ধীকে বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে সেটি আরো দুই বছর চলুক। প্রকৃত ক্ষমতা এখন ভারতীয়দের হাতে। এ পরিস্থিতি যদি দুই বছর পর্যন্ত চলে তাহলে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এ সময়ের মধ্যে তাদের অবস্থান বদলে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতেও পারে।

মাওলানা আজাদ ভেবেছিলেন, দুই বছর পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ একমত হতে বাধ্য হবে। কিন্তু গান্ধি এ প্রস্তাব বাতিল করলেন না এবং কোনো আগ্রহও দেখালেন না।

এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকারের সাথে আলোচনার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডন চলে যান। মাওলানা আজাদ মনে করেন, মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্তের পক্ষেই ছিলেন এবং তিনি তাঁর পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে গিয়েছিলেন।

১৯৪৭ সালের ৩০ মে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। ২ জুন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। তার পর দিন ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা সম্বলিত ‘হোয়াইট পেপার’ বা ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করেন। সেখানে ভারতবর্ষ বিভক্তির রূপরেখা তুলে ধরা হয়।

ব্রিটিশ সরকারের সে ঘোষণার মাধ্যমে ভারতবর্ষ অখণ্ড রাখার সব আশা শেষ হয়ে গেল। মাওলানা আজাদ মনে করেন, ভারতবর্ষ ভাগ করার পেছনে ভারতীয়দের স্বার্থের চেয়ে ব্রিটিশদের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এজন্য শেষ পর্যন্ত বিচার বিশ্লেষণ করে তারা ভারত ভাগ করার দিকেই এগিয়ে গেল।

ব্রিটেন মনে করেছিল, যদি অখণ্ড ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে তাহলে দেশটির ওপর তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব থাকবে না। বিভক্ত ভারতবর্ষ ব্রিটেনের স্বার্থ হাসিল করবে বলেই তাদের ধারণা।

মাওলানা আজাদ লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত হয়ে তার স্বাধীনতার মূল্য দিতে হলো।

(ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি এবং কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বই থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ করে এ লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর ৩০ বছর পর পূর্ণাঙ্গ বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৮ সালে। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সে সময় তিনি কংগ্রেস পার্টির পক্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ফিরোজ বখত। কিন্তু যৌবনে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন মুহিউদ্দিন আহমেদ নামে। পরবর্তীতে তিনি ছদ্মনাম ধারণ করেন আবুল কালাম আজাদ হিসেবে এবং সেটিই তাঁর পরিচয় হয়ে উঠে।) সূত্র: বিবিসি

এ জাতীয় আরও খবর