দুই পায়ে ধরি, ত্রাণ চাই না, খাওয়ার পানি দেন
---
নিউজ ডেস্ক : কয়দিন ধইরা না খাওয়া। শুকনা খাবার, চিড়া-মুড়ি যা ছিল সব শেষ অইয়া গেছে। বাঁইচ্যা থাকার জন্যে বানের পানি খাইয়া ডায়রিয়ায় অইছে। আর পারছি না। আমরা ত্রাণ চাই না। একটু খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে দেন। কোন রকম জীবনটা বাঁচিয়ে রাখি।’
আকুতি করে বলছিলেন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর গাবসারা ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ। এক পর্যায়ে চোখের পানি বের হয়ে আসে লতিফের। বলতে থাকেন, ‘দুইটা পায়ে ধরি। একটু দয়া করেন।’
লতিফের পরিবারের মতো হাজার হাজার পরিবারে এখন হাহাকার। সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ অপ্রতুল। এই অবস্থায় তাদের দুর্দশা লাঘবের কোনো আশাও নেই।
পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচা পেতে পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। হাজার হাজার মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, অন্যের উঁচু জমি ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কোন ভালো গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করালেই ত্রাণের আশায় ছুটে যাচ্ছে গাড়ির কাছে।
গাবসারা ইউনিয়নের কালিপুর গ্রামের ফরিদা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বানের পানিতে ঘরবাড়ি ডুইবা গেছে। বিপদের মইধ্যে আছি। কেউ খোঁজ নিতে আসে নাই। ভোটের সময় আইলেই আমগর দাম বাইড়া যায়। অহন আমগো কোনো দাম নাই।’
অর্জুনার রামাইল গ্রামের আব্দুল আজিজ বলেন, ‘যমুনার পানিতে ঘর-বাড়ি তলিয়ে গেছে। গরু-ছাগল ও পরিবার নিয়ে জোমারবয়ড়া স্কুলে আশ্রয় নিছি। তিনদিন যাবত কেবল চিড়ামুড়ি খেয়ে ক্ষুধা মিটাইতাছি।’
গোবিন্দপুর বাজারের দোকানি আলি হোসেন বলেন, ‘চরাঞ্চলের মানুষের কেনাকাটার একমাত্র স্থান গোবিন্দপুর বাজার তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছে না। এতে তারা চরম বেকায়দায় পড়েছে।’
এবার টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরে বর্ষা মৌসুমের শুরুটা ভালই চলছিল। জেলার যমুনা-ধলেশ্বরী পার ভাঙনেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু উজানের পানি ধেয়ে এসে আকস্মিকভাবে জেলার ছয়টি উপজেলায় বর্ষাটাকে বন্যায় পরিণত করেছে। গত দুই দিনে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অবনতি ঘটেছে। সদর উপজেলার নওগাঁ-জসিহাটি ও পিংনা-যোকারচর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
বর্তমানে জেলার সদর, ভূঞাপুর, কালিহাতী, গোপলপুর, ধনবাড়ী ও নাগরপুর উপজেলার অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি। পানিতে ডুবে কালিহাতীতে বৃহস্পতিবার এক বৃদ্ধের মৃত্যুও হয়েছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বাধ্য হয়েই ডুবন্ত টিউবয়েলের পানি পান করে পানি বাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বানভাসী মানুষ।
বন্যার পানির তোরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অন্তত ১০টি পাকা ও কাঁচা রাস্তা
ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভূঞাপুর ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলার জন্য ১০ টন চাল ও দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা এখন পর্যন্ত বানভাসী মানুষের কাছে পৌঁছেনি। শুক্রবার যমুনা বিপদসীমার ১৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বইছিল। বন্যা হওয়ায় টিউবওয়েলগুলো পানির নিচে চলে গেছে।
বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইল সদর-৫ আসনের সংসদ সদস্য দুর্গত এলাকায় চারটি ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ করেন। তবে সে সহায়তা পর্যাপ্ত ছিল না। ত্রাণের জন্য শিশু, বৃদ্ধ ও নারী-পুরুষসহ সকল বয়সের লোক ভিড় জমায়। ত্রাণের জন্য বন্যাকবলিত এলাকার চার পাশে হাহাকার চলছে। বাড়ছে পানিবাহিত রোগ।
টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধের সদর উপজেলার পাছ বেথৈর এলাকায় পানির তোরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সদর উপজেলার নওগাঁ গ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে করে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঘারিন্দা ইউনিয়নের নওগাঁ-জসিহাটি বেড়িবাঁধ ভেঙে নওগাঁ, জসিহাটি, তারটিয়া, তীরঞ্জ, ফুলকী ও ময়থা গ্রামসহ তিনটি উপজেলার ২০টি গ্রাম নতুন করে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে কালিহাতী উপজেলার হাতিয়া লৌহজং নদী রক্ষা বাঁধ ভেঙে অন্তত ৫০টি গ্রাম নতুন করে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।
এলেঙ্গা বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন বাজার পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের এলেঙ্গা এলাকায় বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ তৈরি করে মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক খান নুরুল আমীন বলেন, ‘পিংনা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত বেড়িবাঁধে, অর্জুনা, গোলপেচা ও কুঠিবয়ড়া জসিহাটি ও পিংনা-যোকারচর বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে। ক্ষয়ক্ষতির ব্যপারে তাৎক্ষণিক টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সর্তক থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী রয়েছে। সেগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বানভাসীদের কাছে পৌঁছে দেবে।’