আবর্জনার শহর রাজশাহী!
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বাতাসের এমন ধূলিকণা কমিয়ে গেল বছর বিশ্বের সবচেয়ে নির্মল বাতাসের শহরের তকমা পেয়েছে রাজশাহী। কিন্তু সেই নির্মল বাতাস এখন হয়ে উঠেছে দুর্গন্ধময়। গত দু’দিন ধরে নগরবাসীকে পথ চলতে হচ্ছে নাক চেপে। কারণ, শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীদের আন্দোলনের জেরে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিন দিন ধরে তারা কোনো কাজ করছেন না। এ অবস্থায় নগরঘুরে দেখা গেছে, যেন আবর্জনার শহরে পরিণত হয়েছে রাজশাহী। নগরবাসী বলছেন, এমন দুর্ভোগ তারা আগে দেখেননি।
নিজেদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ ১১ দফা দাবিতে গত রবিবার থেকে রাসিকের কর্মচারীরা লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত নগর ভবনের প্রধান ফটকে তালা দেয়া হচ্ছে। রবিবার থেকে তালা ঝুলছে রাসিকের গ্যারেজ এবং রাসিক নিয়ন্ত্রিত শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায়।
রাসিকের কর্মচারী ইউনিয়নের ব্যানারে মঙ্গলবার সকাল থেকেও কর্মচারীরা নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন। নিজেদের দাবি আদায়ে তারা নানা স্লোগান দিচ্ছেন। ঘোষণা দিচ্ছেন- দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবেই। ওদিকে দাবি মেনে নেয়ার কোনো লক্ষণ নেই কর্তৃপক্ষের। ফলে দু’পক্ষের এমন অনড় অবস্থানে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে নগর সংস্থায়।
মঙ্গলবার সকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সবগুলো সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশন ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ। ডাম্পিং স্টেশন থেকে ময়লা উপচে এসেছে রাস্তায়। এতে মানুষের পথ চলতেও সমস্যা হচ্ছে। ডাম্পিং স্টেশন ছাড়াও নগরীর প্রায় সব স্থানে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। বাসাবাড়ির সেসব আবর্জনা ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।
নগরীর বিলশিমলা এলাকার বাসিন্দা আসলাম শেখ (৫০) বলেন, সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে তিনি এমন নোংরা শহর দেখেননি। মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে দাবি আদায়ের এমন দুর্ভোগ কাম্য নয় বলে মনে করেন তিনি।
রাসিকের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিক নেতারা গ্যারেজে তালা দিয়ে রেখেছেন। তাই সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশনগুলো থেকে ময়লা তুলতে রাতে কোনো গাড়ি বের হতে পারছে না। আবার যারা কাজ করেন, তারাও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। নিজেদের আন্দোলন ‘বেগবান’ করতে তারাও গাড়ি বের করার চেষ্টা করছেন না। আর যারা রাতে নগরীর রাস্তাগুলো ঝাড়ু দেন, তাদেরকেও নিষেধ করে রেখেছেন শ্রমিক নেতারা।
এদিকে গত রবিবার থেকেই তালা ঝুলছে রাসিক নিয়ন্ত্রিত শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় ঢোকার সবগুলো গেইটে। ফলে তিন দিন ধরে সেখানে কোনো দর্শনার্থী ঢুকতে পারছেন না। তবে দিনে একবার গেইটের তালা খুলে পশুদের জন্য খাবার ঢোকাতে দেওয়া হচ্ছে। একবেলা খাবার খেয়ে পশুরাও সেখানে ধুকছে।
রাসিকের কর্মচারিরা তাদের ১১ দফা দাবি নিয়ে গেল ১২ জুন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। ওই মানববন্ধনের পর গত ১৯ জুন তালা দিয়ে কর্মবিরতি কর্মসূচিও পালন করা হয়েছিল। ওই দিন আন্দোলনরত কর্মচারিরা ঘোষণা দিয়েছিলেন- দাবি আদায় না হলে ৯ জুলাই থেকে লাগাতার কর্মবিরতি পালন করা হবে। ফলে এ দিন থেকে তারা সেই কর্মসূচি শুরু করেছেন।
রাসিক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি দুলাল শেখ বলেন, গেল বছরের ২৪ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে সিটি করপোরেশনের দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত দক্ষ নিয়মিত কর্মচারিদের দৈনিক ৫০০ টাকা এবং অদক্ষ অনিয়মিত কর্মচারীদের প্রতিদিন ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গেল এক বছরেও করপোরেশন কর্মচারিদের দৈনিক মজুরি বাড়ায়নি।
অন্য সিটি করপোরেশনে সরকারি নিয়মে বেতন দেয়া হলেও রাসিকে ৩৩০ টাকা করে দেওয়া হয়। এতে রাসিকের ২ হাজার ২০০ জন কর্মচারি সরকারি নিয়মে তাদের মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই ১১ দাফা দাবিতে কর্মসূচি শুরু করেছেন তারা। দাবি মানা না হলে আগামিতেও আন্দোলন চলবে বলে জানান তিনি।
তবে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সিটি মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেছেন, তাকে বেকায়দায় ফেলতেই এ আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনে সিটি করপোরেশনের হাতেগোনা কয়েকজন শ্রমিক আছেন। বাকিরা বহিরাগত। একটি মহল এসব লোক এনে আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।
এ আন্দোলনে রাসিকে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে স্বীকার করে মহানগর বিএনপির সভাপতি মেয়র বুলবুল বলেন, ‘রাসিকে এতোদিন কোনো আন্দোলন হয়নি। আমি দায়িত্ব ফিরে পেলাম দু’মাস আগে। আর এখনই শুরু হলো আন্দোলন। এর হেতু কী? এটা সবাই বুঝতে পারছে, আমিও পারছি। এখন ঢাকায় আছি। ফিরে গিয়ে আমি কর্মচারীদের সঙ্গে বসার চেষ্টা করবো।’
তিনি জানান, কর্মচারীরা ১১ দফা দাবি তুললে গত বৃহস্পতিবার সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা এবং কাউন্সিলররা আলোচনায় বসার জন্য কর্মচারীদের ডেকেছিলেন। কিন্তু তারা এতে সাড়া দেননি। উল্টো রোববার থেকে তারা আন্দোলন শুরু করেছেন। এরই মধ্যে কর্মচারীদের ৯টি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এর পরেও এমন আন্দোলন অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন মেয়র।
কর্মচারীদের দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারিদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী মজুরি প্রদান, স্থায়ী কর্মচারিদের জ্যৈষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি, স্থায়ী কর্মচারীদের গৃহ নির্মাণের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা, মৃত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারিদের পোষ্যদের চাকরি প্রদান, শোকজ বা চাকরিচ্যুত না করা এবং মজুরিভিত্তিক কর্মচারিদের চাকরি স্থায়ীকরণ।