পাহাড়ি ঢলে লামায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
---
নিজস্ব প্রতিবেদক : এক মাসের মাথায় ফের টানা তিন দিনের মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের লামা পৌর এলাকাসহ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের শতশত ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে মাতামুহুরী নদী, লামাখাল, ইয়াংছা খাল, বগাইছড়িখাল ও পোপা খালসহ বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ি ঝিরিগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে বিভিন্ন পেশাজীবীর প্রায় ১০ হাজার মানুষ। কর্মহীন হয়ে বেকায়দায় পড়েছে শ্রমজীবী মানুষগুলো।
একটানা বৃষ্টির কারণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসও দেখা দিয়েছে। বর্ষণের পানির স্রোতে সড়ক ভেঙ্গে ও সড়কের উপর পাহাড় ধসে পড়ে বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার সকাল নাগাদ মাতামহুরী নদীর পানি বিপদসীমা ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ভারী বর্ষণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানের পাহাড় ধসে প্রানহানির আশঙ্কায় উপজেলা প্রশাসন, লামা পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর পক্ষ থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। বন্যা কবলিতদেরকে আশ্রয় নেয়ার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের আবাসিক কোয়ার্টারসমূহ খুলে দিয়েছে প্রশাসন। টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ বন্যাসহ পাহাড়ধসে মানবিক বিপর্র্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। মঙ্গলবার সকালে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত টানা বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, রবিবার সকাল থেকে মুষুলধারে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। আর এ টানা বর্ষণের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে উপজেলায় অবস্থিত নদী, খাল ও ঝিরির পানি ফুঁসে উঠে মঙ্গলবার সকাল নাগাদ লামা পৌর এলাকার নয়াপাড়া, বাসস্টেন্ড, টিএন্ডটি পাড়া, বাজারপাড়া, লামা বাজার, চেয়ারম্যান পাড়ার একাংশ, ছোট নুনারবিলপাড়া, বড় নুনারবিলপাড়া, লাইনঝিরি, ফকিরপাড়া, হাজ্বীপাড়া, কলিঙ্গাবিলপাড়া, উপজেলা পরিষদের আবাসিক কোয়ার্টার সমূহ, থানা এলাকা, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ইয়াংছা বাজার, হারগাজা, বগাইছড়ি, বনপুর ও লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা, বৈল্লারচর, শীলেরতুয়া, দরদরী, অংহ্লাপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে পৌর এলাকার হলিচাইল্ড পাবলিক স্কুল, নুনারবিল সরকারী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়সহ সহস্রাধিক ঘরবাড়ি রয়েছে।
আবার অতি বৃষ্টির কারনে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধ্বস দেখা দিয়েছে। পাহাড় ধসে পড়ে, পাহাড়ি ঢলের পানি ও স্রোতের টানে ভেঙ্গে গেছে বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার জানান, পাহাড়ি ঢলের পানিতে ইয়াংছা বাজার, হারগাজা, বগাইছড়ি এলাকা প্লাবিত হয়। প্রবল বর্ষণে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ে ও বর্ষণের পানির স্রোতের টানে ইয়াংছা-বনপুর, বগাইছড়ি-হারগাজা-সাফেরঘাটা সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে লামা-ফাঁসিয়াখালী সড়কের বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় ঝিরিগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে।
ঢলের পানিতে অংহ্লাপাড়া, দরদরী, শীলেরতুয়া এলাকা নিমজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি ঝিরির পানি বৃদ্ধি পেয়ে বহু মানুষ গৃহবন্দি ও রাস্তাঘাটের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন রুপসীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছাচিংপ্রু মার্মা। আজিজনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন জানায়, প্রবল বর্ষণে ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা, বৈল্লারচরসহ নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হওয়ার খবর জানান চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন। এদিকে খাল ও ঝিরির পানি বৃদ্ধি পেয়ে লামা পৌরসভা, লামা সদর, গজালিয়া, ফাইতং, ফাঁসিয়াখালী, আজিজনগর, সরই ও রুপসীপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ১০ হাজার মানুষ গৃহবন্দি হয়ে দুর্ভোগে রয়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। এছাড়া ওই এলাকার রাস্তা ঘাট লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।
লামা-আলীকদম সড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আলীকদমের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার আশংকায় স্থানীয়রা শংকিত হয়ে পড়েছেন। বাজারের ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল এবং উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর সমূহ বন্যার আশঙ্কায় মালামাল ও নথিপত্র নিরাপদে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এদিকে আলীকদম উপজেলায়ও পাহাড়ি ঢলের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত মানুষগুলো নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে।
লামা বাজার পাড়ার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী মো. সেলিম, জাকির হোসেন, পিপলু বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ৪-৫ বার পাহাড়ি ঢলের পানিতে ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়। ঢলের পানি ওঠার সময় ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয়। এমনকি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
লামা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাপান বড়ুয়া জানান, গত দুই দিনের বর্ষণে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঢলের পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবসায়ী ও পরিবারগুলো তাদের মালামাল নিরাপদে সরিয়ে নিচ্ছেন। দ্রুত পানি বৃদ্ধির কারণে কেউ কেউ আবার ক্ষতির সম্মুখিন হয়। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে লামা পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে চলতি মৌসুমের বীজতলা এবং বিভিন্ন ফসলাদি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
পৌরসভা মেয়র মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, পৌরসভার কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে বন্যার পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক তদারকি করার জন্য কমিটি গঠন করার পাশাপাশি প্লাবিত লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রিত ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিতদের মধ্যে শুকনো খাবার দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, মাইকিং করে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদেরকে নিরাপদে আশ্রয় গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।
লামা লামা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী জানান, বন্যা কবলিতদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে পৌর এলাকাসহ ইউনিয়নগুলোতে মাইকিং করে জনসাধারণকে নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যনদেরকে বলা হয়েছে।