সোমবার, ১৯শে জুন, ২০১৭ ইং ৫ই আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

চিনি নিয়ে কারসাজি: সিন্ডিকেটের পকেটে ৫শ’ কোটি টাকা

AmaderBrahmanbaria.COM
জুন ১৭, ২০১৭
news-image

---

নিউজ ডেস্ক : প্রতিবছর রমজান মাস এলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে চিনির সিন্ডিকেট। সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা লুটে নেয় ওই সিন্ডিকেট। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কারসাজি করে এবারের রোজায় ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা লুটে নিচ্ছে চিনি সিন্ডিকেট। আর এই লুটে নেওয়া অর্থ দেশের সাধারণ মানুষের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা রয়েছে ১৮-২০ লাখ টন। শুধু রমজান মাসেই প্রয়োজন হয় প্রায় আড়াই লাখ টন চিনির। অর্থাত্ রমজান মাসে দরকার পড়ে ২৫ কোটি কেজি চিনির। এবারের রোজার আগে দেশে যেসব চিনি আমদানি করা হয় তার আমদানি মূল্য পড়ে ৩৮ টাকা ২৫ পয়সা। এর বাইরে আমদানি শুল্ক, উত্পাদক, পাইকারি ও খুবরা ব্যবসায়ীদের খরচ এবং মুনাফা বাবদ যুক্ত হয় ২০ টাকা। সে হিসাবে এক কেজি চিনি ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হওয়ার কথা ৫৮-৫৯ টাকায়। কিন্তু এবারের রোজায় প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। অর্থাত্ কেজিপ্রতি বাড়তি তুলে নেওয়া হচ্ছে ২১ টাকা। সুতরাং এবারের রোজায় ২৫ কোটি কেজি চিনি বিক্রি করে চিনি ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফা তুলে নেবে ৫২৫ কোটি টাকা।

চিনি ব্যবসায়ীদের বাড়তি মুনাফার বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান, ব্যবসায় মুনাফা থাকবে, মুনাফা করতে হবে-এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটার তো একটা মাত্রা আছে। পাইকারি পর্যায়ে ৪-৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ১০ শতাংশ মুনাফা করলে সেটা নিয়মমাফিক হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা রোজা এলে বেসামাল হয়ে পড়ে। অধিক মুনাফার লোভে তারা সাধারণ মানুষের পকেট কাটে। এটা মোটেই ঠিক নয়। এই অতি মুনাফার মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। রোজা আমাদের সংযমী হতে শিক্ষা দেয়। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা হাঁটে উল্টোপথে। তারা সারাবছর অপেক্ষায় থাকে কবে রমজান আসবে আর সারাবছরের মুনাফা তুলে নেবে এই এক মাসে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের এই বেপরোয়া মুনাফার পেছনে সরকারেরও দায় রয়েছে। সরকার সবকিছু সঠিকভাবে মনিটরিং করলে তারা এত মুনাফা তুলতে পারত না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিল ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা উভয়ের যোগসাজশেই এই অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নেয়। এ বছরই শুধু নয়, প্রতি রমজানেই চিনি নিয়ে এমন কারসাজি হচ্ছে। তাও একই পন্থায়। প্রথম দফায় রোজার আগ দিয়ে মিলগুলো বন্ধ রেখে বাজারে সরবরাহে সঙ্কট তৈরি করা হয়। এরপর সরবরাহ কমিয়ে পাইকারি বাজারে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীকে চিনি সরবরাহ দেওয়া হয়। যারা চিনি সরবরাহকারী মিলগুলোর মনোনীত ব্যবসায়ী।

সাধারণ ব্যসায়ীরা এ সময় মিল থেকে চিনি পায় না। সৃষ্ট এই কৃত্রিম সঙ্কটে চিনির ভরসা সেই হাতেগোনা ব্যবসায়ীরা। তখন অস্থিরতার সুযোগে ওই বড় অঙ্কের টাকা চলে যায় সেই মিল ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে। অবশ্য এ অভিযোগ মানতে নারাজ চিনি মিলের কর্তাব্যক্তিরা। এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রোজার আগে কিছু দিন আমাদের মিল বন্ধ ছিল ঠিকই। তবে তারপর থেকেই নিয়মিত চিনি সাপ্লাই দিচ্ছি। এখনও প্রতিদিন আড়াই হাজার টন চিনি সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি খোলাবাজারে ১০টি পয়েন্টে ৬০ টাকা কেজি দরে ট্রাকসেলে আমরা চিনি দিচ্ছি। ‘চিনির বাজারে মিলগুলো সিন্ডিকেট করে না’-এমন দাবি করে তিনি বলেন, আমরা সরবরাহ পরিস্থিতি সরকারকে নিয়মিত অবহিত করছি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ৫৮ টাকা দরে মিল নিয়ে কেন বাজারে এত ব্যবধানে বিক্রি করছে? এ প্রশ্নের জবাব তাদের দেওয়া উচিত।

দেশের শীর্ষ পাঁচটি বেসরকারি চিনিকল থেকে দৈনিক প্রায় আট হাজার টন চিনি বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। বর্তমানে প্রতিদিন সিটি গ্রুপ থেকে ২৯০০-৩০০০ হাজার টন, মেঘনা গ্রুপ থেকে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টন, ঈগলু গ্রুপ থেকে ৫০০-৭০০ টন, দেশবন্ধু গ্রুপ থেকে ৫০০ টন, এস আলম থেকেও ৫০০ টন চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। কিন্তু এরপরও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারে চিনির সরবরাহ অনেক কম। চাহিদা অনুযায়ী চিনির ডিও নিষ্পত্তি করছে না মিল কর্তৃপক্ষ।

প্রতিদিন চিনি আনতে ট্রাক নিয়ে মিলগেটে অপেক্ষা করে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। চিনি মিলছে দু’তিন দিন পর। তাই বাজারে চিনির সরবরাহ কম। খরচ বাড়ছে। ফলে দামও কমছে না। অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, দেশে প্রচলিত পরিবেশক আইন বহাল থাকলেও এসব পণ্যের ক্ষেত্রে তা অকার্যকর। মিলমালিকরা কারসাজি বহাল রাখতেই তা মানছে না। ফলে ডিও’র নামে সিন্ডিকেট করে মনোনীত ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছে তারা। স্বচ্ছতা আনতে এই সনাতন পদ্ধতি বাতিল করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি আবুল হাসেম জানান, মিলগুলো থেকে চাহিদা অনুযায়ী চিনি না পাওয়ায় বাজারে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এসব অস্বীকার করার সুযোগ নেই মিলের। আগে তো সাধারণ ব্যবসায়ীরা ১০০ টন চিনির ডিও নিয়ে গেলে ১০ টন চিনি দিয়ে বিদায় করা হয়েছে। তখন তারা বলেছে, আমরা তো সরবরাহ দিচ্ছি। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী আবার ঠিকই চিনি পেয়েছে। তারাই বেশি দামে বিক্রি করছে। তিনি বলেন, যারা মিলের পছন্দের ব্যবসায়ী, যারা আলাদা খরচ দেয়। তারা ঠিকই চিনি পায়। সাধারণ ব্যবসায়ী ডিও নিয়ে বসে থাকে। সবই মিলের আর ওইসব ব্যবসায়ীর কারসাজি। বাড়তি মুনাফাও তুলে নেয় ওই মিলমালিকরাই।

এ জাতীয় আরও খবর