হাওর বিপযর্য়ের কারণ ধানগাছ
নিজস্ব প্রতিবেদক : হাওরে আগাম বৃষ্টির কারণে অপরিপক্ক ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ধান পচে যায়। ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে পানির অম্লত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছর মৃত্যু হয়েছে। তবে হাওরে এখনও ১৯ প্রকারের মাছ ও জলজ প্রাণির পোনা পাওয়া গেছে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে হাওরের পানিতে এমোনিয়া ও নাইট্রাইটের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের সভা কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান মৎস্য চাষ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। সিলেটের টাঙ্গুয়ার হাওর, জামালগঞ্জের হালির হাওর ও সুনামগঞ্জের দেখার হাওর পরিদর্শন করে এসে তারা এই গবেষণা রিপোর্ট উপস্থাপন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, মাছের আকস্মিক মৃত্যুর ধরণ ও ব্যাপকতা দেখে বোঝা যায়, কোনো জীবাণুবাহিত রোগের কারণে মাছের মৃত্যু হয়নি। গত ১২ চৈত্র বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের ধান তলিয়ে যায়, প্রায় ২২ দিন পর বৈশাখের ৫ তারিখে মাছের মড়ক দেখা দেয়। এ থেকে বোঝা যায়, যদি পানিতে কোনো ধরনের ভারী পদার্থ বা তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকত, তাহলে পানি আসার শুরু থেকেই মাছ মারা যেত। অন্যদিকে হাওরের মোট আয়তনের তুলনায় ধান চাষের জমির আয়তন কম এবং হাওরের গভীরতা বেশী সেখানে মাছের মৃত্যু তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। আর যে সমস্ত হাওরের মোট আয়তনের তুলনায় ধান চাষের জমির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি এবং হাওরের গভীরতা কম সেখানে মাছের মৃত্যু বেশি হয়েছে।
অপরদিকে হাওরের বোরো ধানক্ষেতে জন্মানো বিষাক্ত পোকামাকড়গুলো খাওয়ার কারণে হাঁসের মৃত্যু হতে পারে বলেও বাকৃবি গবেষকরা ধারণা করছেন। তারা জানান, মৃত হাঁসের রক্ত পর্যলোচনা করে রক্তে কোন বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
তারা বলেন, হাওরের সমস্ত ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মানুষ একেবারেই খাদ্যহীন হয়ে পড়েছে। মানুষের ঘরে মজুদকৃত কোন খাদ্য অবশিষ্ট নেই। সেজন্য চাল কেনার অর্থ যোগাড় করতে মানুষ হাওর থেকে মাছ আহরণের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। এতে করে হাওরের অবশিষ্ট মা মাছগুলো কমে যাবে। ফলে হাওরে মাছ পাওয়া যাবে না এবং বাজারে মাছের পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমে যেতে পারে।
হাওরের মৎস্য সম্পদ সংক্রান্ত এই বহুমুখী ও জটিল সমস্যা থেকে উত্তরণ ও মাছের পূর্বেকার প্রাচুর্য্য ফিরে পেতে বিভিন্ন রকম সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞ টিম। হাওরবাসীদের এই কঠিন সময়ে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ঋণ প্রদানে মোবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। হাওর অঞ্চলে খাঁচায় মাছ চাষ সম্প্রসাণের জন্য সমাজভিত্তিক খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প হাতে নেয়া প্রয়োজন। হাওরে অবৈধ জাল ও অন্যান্য গিয়ার দিয়ে মৎস্য আহরণের চাপ কমাতে হবে। মাছের বৈচিত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য হাওরে লিজ কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
তারা বলেন, প্রয়োজনে অন্য উৎস্য থেকে গুণগতমানের মাছের রেণু সংগ্রহ করে হাওরে ছাড়তে হবে। আগামী অন্তত ৬ মাস মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরকে হাওরের মৎস্য সম্পদের সার্বিক অবস্থা নিয়মিত মনিটরিং করার কাজ হাতে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত দীর্ঘ মেয়াদি গবেষণা প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
তারা জানান, এখনও হাওরের মাটি, পানি, পঁচা ধানগাছ ইত্যাদির নমুনা বিশ্লেষণের কাজ চলছে। এগুলো শেষ হলে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। হাওরের এ দুর্যোগের পরিণাম এখনই শেষ নয়, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, কারণ বৃষ্টির পরে রোদ্রাবস্থায় ধানের নাড়ার পঁচনে পরিবেশ আরো দূষিত হয়ে মাছের রোগ বা মৃত্যু হতে পারে, এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টি উপর নজরে রাখতে হবে।
এর আগে মাছের মড়কের সঠিক কারণ নির্ণয় ও পানির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ করে পরামর্শ প্রদানের জন্য ২৪ এপ্রিল হাওরে যায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের বিশেষজ্ঞ দল। বিশেষজ্ঞ দলের আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক।
৬ সদস্য বিশিষ্ট ‘মাছের মড়ক পর্যাবেক্ষণ ও অনুসন্ধানী টিম’ এর অন্যান্য সদস্য হলেন মাছ চাষ বিভাগের অধ্যাপক ড এসএম রহমত উল্লাহ, ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম নওশাদ আলম, মাছচাষ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আলী রেজা ফারুক, ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহান, ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. একে শাকুর আহম্মদ।