মুফতি হান্নানের যত হামলা
প্রায় দেড়যুগ আগে ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে হামলার মধ্যদিয়ে দেশে প্রকাশ্যে জঙ্গি কার্যক্রমের সূচনা করে মুফতি আব্দুল হান্নানের দল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের অক্টোবরে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত মুফতি হান্নানের নির্দেশে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ ২০টি জঙ্গি হামলা চালানো হয় দেশের বিভিন্নস্থানে। এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই চারবার হত্যার চেষ্টা করে মুফতি হান্নানের দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি)।
পুলিশ সদর দফতর, আদালত ও মানবাধিকার কর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মুফতি হান্নানের সংগঠন হুজিবি প্রথম হামলাটি চালায় ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত হন। আহত হন আরও শতাধিক নারী-পুরুষ। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনার আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা চালায় হুজির জঙ্গিরা। এ হামলায়ও নিহত হন আটজন।। ২০০০ সালের ১৩ জুলাই ফরিদপুরে এক পীরের মাহফিলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার অন্যতম হোতা হিসেবে মনে করা হয় মুফতি হান্নানকে। এ ঘটনায়ও একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হন। কিন্তু তখনও এসব বোমা হামলা কারা চালাচ্ছে, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের কাছে ও হেলিপ্যাডে বোমা পুঁতে রাখার ঘটনা ধরা পড়ার পরই হুজি-বি ও মুফতি হান্নানের বিষয়ে জানতে পারেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। সমাবেশের দুদিন আগে প্যান্ডেল তৈরির সময় প্রায় ৭৬ কেজি ওজনের ওই বোমার সন্ধান পান ডেকোরেটর কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে আগের ঘটনাগুলোও তারাই ঘটিয়েছিল।
২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা চালায় হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা। এ হামলায় ঘটনাস্থলে চারজন ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও একজন।। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে হামলা চালায় হুজি-বি। এ হামলার ঘটনায় ১০ জন নিহত হন। আহত হন আরও অনেকে।একই বছরের ৩০ মে খুলনায় শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনায় মুফতি হান্নান ছিল বলে জানতে পারেন গোয়েন্দারা। কিন্তু ২৭ মে তার সহযোগীরা গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এর কয়েকদিন পর ৩ জুন গোপালগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গির্জায় হামলা চালায় হুজি-বি। এরপর ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলার জন্যেও দায়ী করা হয় এই সংগঠনটিকে। ওই বছরই ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে আরও একদফা শেখ হাসিনাকে বোমা মেরে হত্যার পরিকল্পনা করে মুফতি হান্নান। কিন্তু বোমা বিস্ফোরণে হুজির দুই জঙ্গি নিহত হওয়ায় সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয় তার।
২০০৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে হোমিও চিকিৎসক আব্দুল আজিজ অপহৃত হন। পরে গাজীপুরের পোড়াবাড়ি এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও পুলিশসহ তিনজন নিহত হন। কয়েকদিন পর ২১ জুন সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমাবেশে বোমা হামলা চালায় হুজি-বি’র জঙ্গিরা। এ ঘটনায় একজন নিহত হন। আহত হন আরও কয়েকজন। একই বছরের ৭ আগস্ট সিলেটে তৎকালীন মেয়র বদরুদ্দিন আহমেদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় মেয়র কামরান বেঁচে গেলেও মারা যান অপর একজন।
দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও জঘন্য হামলা চালানো হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে। এ হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন প্রায় চারশ মানুষ। এই ভয়াবহ হামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মুফতি হান্নান। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর সিলেটে আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা জেবুন্নেছা হকের বাসায় মুফতি হান্নানের সহযোগীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
হবিগঞ্জে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। কিবরিয়া ছাড়াও এ ঘটনায় আরও চারজন নিহত হন। পরের মাসেই ২ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় স্থানীয় পৃথিমপাশা গ্রামে পবিত্র আশুরার অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ ঘটনার জন্যেও মুফতি হান্নানকে দায়ী করা হয়।
একই বছরের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা থেকে গ্রেফতার হন মুফতি হান্নান। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মুফতি হান্নানের দল হুজি-বি প্রায় দুই ডজন হামলা ও হামলার চেষ্টা চালায়। এসব হামলায় শতাধিক লোক নিহত হন। আহত হন সাত শতাধিক। পঙ্গু হয়ে যান আরও অনেকে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে দু’টি মামলার বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। যার একটি তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা মামলা।সেই মামলার রায় কার্যকর হলো আজ বুধবার রাত ১০টায়।
মানবাধিকার কর্মী ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক গবেষক নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মাধ্যমে মুফতি হান্নানের হুজি-বি দেশে নাশকতার কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ আরও অনেকগুলো ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। কখনও তার নেতৃত্বে, কখনও তার নির্দেশে ও পরিকল্পনায় দেশে অনেক বোমা হামলা ও গ্রেনেড হামলা হয়েছে।’ তার ফাঁসির মধ্যদিয়ে এ দেশে হুজি-বি’র একটি অংশের যবনিকাপাত ঘটতে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।