বারবার কারাগার থেকে পালাতে চেয়েছিল মুফতি হান্নান
কারাগারে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এসব পালানোর ছক বাস্তবায়ন করতে পারেনি এই জঙ্গি নেতা।
গত ৬ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাজীপুরের টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় হুজি নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের বহনকারী প্রিজন ভ্যানে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ সময় ট্রাফিক পুলিশ ও পথচারীরা মোস্তফা কামাল (২২) নামে এক জঙ্গিকে আটক করে। এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই টঙ্গী থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ ( মামলা নম্বর ১০)। প্রথমে মামলাটি টঙ্গী থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পরবর্তীতে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। টঙ্গী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার এই তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ‘মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা তদন্ত করছেন।’
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত একটি মাদ্রাসার একজন শিক্ষক ও আরও এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তি থেকে পুলিশ নিশ্চিত হয় মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যই এই হামলা চালানো হয়েছিল।
গাজীপুরের ডিবি পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, নরসিংদীর শেখেরচর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় বসে জঙ্গিরা দীর্ঘদিন ধরে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। আদালতে তার হাজিরা যে ৬ মার্চ, তা আগেই জানা ছিল তাদের। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী টঙ্গীর চেরাগ আলীর কলেজ গেট এলাকায় প্রিজন ভ্যানে ও পুলিশের গাড়িতে হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়। শেখেরচরের মাদ্রাসাটির কেতাব বিভাগের সাবেক শিক্ষক ফোরকান ও বর্তমান শিক্ষক আজিজুল সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। আজিজুল হামলার দিন স্পটেই ছিল। হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকগুলো ফোরকান দিয়েছিল বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে মোস্তফা ও মিনহাজ। হামলার পর জঙ্গিরা শেখেরচরের ওই মাদ্রাসায় ফিরে যায়। হামলাকারীদের বেশিরভাগই ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। গ্রেফতারকৃত মাদ্রাসা শিক্ষক আজিজুলের বাড়ি কালিগঞ্জে।
গত ১৯ মার্চ বিকালে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে হামলায় জড়িত দুই জঙ্গি। এদের মধ্যে মোস্তফা কামাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াস রহমানের আদালতে এবং মিনহাজুল জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল হাইয়ের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারা দুজনেই মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা আদালতে স্বীকার করে।
এরআগে গত বছরের ডিসেম্বরে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে পালানোর পরিকল্পনা করেছিল মুফতি হান্নান। দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এমন রিপোর্ট ছিল। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রাচীর টপকে পালানোর একটি ছকও করেছিল সে। কারাগারের ওই অংশের নিরাপত্তা দেয়ালের ওপর বৈদ্যুতিক প্রাচীর নেই। এই সুযোগটি নিতে চেয়েছিল জঙ্গি নেতা হান্নান। এমনকি কাশিমপুর কারাগারে বসে সম্প্রতি মুফতি হান্নান তার এক সহযোগীর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে। পরে ওই মোবাইলফোনটি জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় একজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ।
২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে তিন জঙ্গিকে বহনকারী পুলিশের প্রিজনভ্যানে হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্যরা। এ সময় জঙ্গিরা পুলিশের একজন সদস্যকে হত্যা করে সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন, বোমা মিজান ও হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব নামের তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়। পরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে রাকিব মারা যায়। আর বোমা মিজান ও সালেহীন পালিয়ে যায় ভারতে।
কারা কর্তৃপক্ষ একাধিকবার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জঙ্গিদের পাঠানো ষড়যন্ত্রের চিঠি, মোবাইল, সিম ও বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করেছে। ত্রিশালে জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কারাকর্তৃপক্ষ তৎপর হয়। এই তিনবছরে জঙ্গিরা পালিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন ছক কষলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
মুফতি হান্নান কাশিমপুর কারাগারে বসে মোবাইল ফোনে ভেতরের বন্দিসহ বাইরের জঙ্গিদের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ ও চক্রান্ত করে। কারা কর্তৃপক্ষ এমন তথ্য-আলামত পায়। এরপর ত্রিশালের মতো একই কায়দায় মুফতি হান্নানসহ ১৯ জঙ্গি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয় টঙ্গীতে।
টঙ্গীতে মুফতি হান্নানকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানে হামলার পর পুলিশ জঙ্গিদের কয়েকটি গ্রুপকে চিহ্নিত করেছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাসেল হোসেন বলেন, ‘টঙ্গীতে হামলার পর আমরা জড়িতদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি। তারা দোষ স্বীকার করেছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
বাংলা ট্রিবিউন