অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে ৩৩ ভাগ টাকার নোট
নিজস্ব প্রতিবেদক : পণ্য বা সেবা বিনিময়ের মাধ্যম মুদ্রা। এটি অর্থনীতির অন্যতম অনুসঙ্গ। দেশভেদে মুদ্রার ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। বাংলাদেশি মুদ্রার নাম ‘টাকা’।
টাকার নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু টাকার নোট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক নজরদারির অভাবে প্রতিবছর সরকারকে নির্ধারিত খরচের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে।
কারণ, ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের কারণে টাকার নোট ছিঁড়ে যায়, পুড়ে যায় কিংবা এর রং ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ফলে একসময় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে বিপুল পরিমাণ টাকার নোট। ব্যবহারের অযোগ্য এসব টাকা পুরোপুরি নষ্ট করে ফেলতে হয়। সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকও এ কাজ করে থাকে।
একই সঙ্গে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পুরাতন ওই নোটের সমপরিমাণ নতুন নোট ছাপাতে হয়। এতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেড (টাকশাল) সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ টাকা নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে অযত্নে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে।
টাকশাল প্রতিবছর ২ থেকে ১০০০ টাকা মূল্যমানের ১০০ কোটি পিস নোট ছাপায়। প্রতিটি নোট ছাপাতে বর্তমানে গড়ে ৩.৪৮৫ টাকা খরচ হয়। সে হিসেবে ১০০ কোটি পিস নোট ছাপাতে সরকারের খরচ হয় ৩৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বাহকরা যদি একটু সতর্কভাবে টাকার নোট ব্যবহার করেন তাহলে এই খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধ থাকা সত্বেও ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট মোটা পিন মেরে বা সুতা দিয়ে গেঁথে বান্ডিল করেন এর বাহকরা। তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এ কাজ করে থাকে। এই পিন বা সুতা খুলতে গিয়ে ওই বান্ডিলের অনেক নোট ছিঁড়ে যায়।
এ ছাড়া অতি ব্যবহার ও অযত্নে ব্যবহার হওয়া্য় অনেক নোট একপর্যায়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ২, ৫, ১০, ২০ ও ৫০ টাকার নোট বেশি নষ্ট হয়। বাহকদের সতর্কতার অভাবে অনেক নোট শ্রীহীন ও নরম হয়ে যায়। আগুনে আংশিক পুড়েও অনেক টাকা অচল হয়ে পড়ে। ছোট নোটগুলো পরিবর্তনের জন্য সহজে কেউ ব্যাংকে যান না। আর পরিবর্তনের জন্য গেলেও ব্যাংকগুলোতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেডের (টাকশাল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিয়াউদ্দীন আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা শুধু ১০০০ টাকার নোট বান্ডিল করার সময় পিনআপ করি। অন্য কোনো নোটে পিনআপ করি না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা রয়েছে, নোটের গায়ে বড় পিনআপ করা যাবে না। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে বড় নোটগুলোতে ছোট পিনআপ করা যাবে। কিন্তু এই নির্দেশনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মানছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের।’
নোট ছাপানোর বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টাকা ছাপাতে সরকারের কত বাজেট সে বিষয়ে বলতে পারব না। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী টাকা ছাপাই। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে নোট ছাপানো হয়েছে ৭০৫ মিলিয়ন পিস। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছাপানো হয়েছে ১ হাজার ২৫৮ মিলিয়ন পিস। আর গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছাপানো হয়েছে ১ হাজার মিলিয়ন পিস।’
টাকা ছাপানোর খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ টাকার নোট ছাপা হয়নি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ টাকার নোট প্রতিটি ছাপাতে খরচ পড়েছে ১.১৬ টাকা। অন্যদিকে গত অর্থবছরে ৫ টাকার প্রতিটি নোট ছাপাতে ১.৫৯ টাকা, ১০ টাকার নোট ছাপাতে ২.০১ টাকা, ২০ টাকার নোট ছাপাতে ২.৩৩ টাকা এবং ৫০ টাকার নোট ছাপাতে ২.১৬ টাকা খরচ হয়। আর ১০০ ও ৫০০ টাকার প্রতিটি নোট ছাপাতে খরচ হয় যথাক্রমে ৫.৯৩ টাকা ও ৫.০৮ টাকা। এ ছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০০০ টাকার প্রতিটি নোট ছাপাতে খরচ হয়েছে ৭.৬২ টাকা।’
টাকা নষ্ট হওয়ার কারণ সম্পর্কে জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের নোট ছাপানোর কাগজ ও কালির মান পৃথিবীর যে কোনো দেশের সমতুল্য। কোনো কোনো নোট অন্যান্য দেশের নোটের মানের চেয়েও ভালো। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের ব্যবহার পদ্ধতি ভালো না। বিশেষ করে ছোট ছোট নোটগুলো রিকশাচালক, হকার, মাছবিক্রেতা কিংবা শ্রমজীবী মানুষরা অনেকক্ষেত্রে সতর্কভাবে ব্যবহার করেন না। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে আর্দ্রতা ও ধুলা অনেক বেশি। তাই ছোট নোটগুলো তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়।’
তিনি জানান, প্রতিবছরই টাকা তৈরিতে খরচ বাড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। কাঁচামালের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। একই সঙ্গে অন্যান্য খরচও বাড়ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরদারির মধ্যে আছে। আমরা যখনই কোনো টাকা পিন মারা অবস্থায় পাই, কারা পিন মারল সেটা যাচাই করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই।’
তিনি বলেন, ‘ব্যবহারকারীদের অসতর্কতায় টাকার নোট ছিঁড়ে যায়, পুড়ে যায় কিংবা রঙ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ফলে একসময় তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব নোট পুড়িয়ে ফেলে। এর পরিবর্তে নতুন করে নোট ছাপাতে হয়। সে নোট ছাপাতে সরকারকে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়।’