রবিবার, ২৩শে এপ্রিল, ২০১৭ ইং ১০ই বৈশাখ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

বাঞ্ছারামপুরে পরিবার পরিকল্পনা ও কমিউনিটি ক্লিনিকের বেহাল দশা

AmaderBrahmanbaria.COM
জানুয়ারি ২৫, ২০১৭
news-image

বিশেষ প্রতিনিধি : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন অনিয়ম, জনবল সংকট ও ঔষধ সরবরাহ থাকলেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌছাচ্ছেনা কাঙ্খিত সেবা। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে কর্মরত মাঠকর্মী, মাঠ সুপারভাইজার, ভিজিটর ও ডাক্তাররা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও মাস শেষে বেতন উত্তোলন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে জন্মনিয়ন্ত্রণের সরকারের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না কোনভাবেই। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা একেএম সেলিম ভূইয়ার বিরুদ্ধে ফাঁকিবাজ মাঠকর্মীদের কাছ থেকে মাসোহারা নেওয়া, শোকজবাণিজ্য সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রেও চলছে দায়িত্ব অবহেলা, ঔষধপত্র বিতরণে অনিয়ম, ভুয়া কেনাকাটা ও ডেলিভারী দেখিয়ে মোট অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ ব্যাপক আকারে নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই চলছে স্বাস্থ্য সেবা। কেন্দ্রের অভ্যন্তরে যত্রতত্র পরে থাকা ময়লা-আবর্জনা ও জমে থাকা নোংরা পানির কারণে পরিবেশ হয়ে উঠছে অস্বাস্থ্যকর। তেজখালী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রে নিয়মিত রাতে মাদক সেবন ও জুয়ার আসরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েও মিলছেনা কোন সুফল।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা একেএম সেলিম ভূইয়া প্রায় সময়ই পারিবারিক কাজে নিজ এলাকা নরসিংদীতে থাকেন। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মোস্তাক উদ্দিন আহমেদ খান ঢাকা ধানমন্ডির জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডসশীপ হাসপাতালে নিয়মিত ডিউটি করেন। এসব ফাঁকিবাজ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রতিমাসে মাসোহারা নিচ্ছেন উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগ রয়েছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি এলাকাবাসী।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসারের ১০টি পদই শূন্য, ফার্মাসিস্টের ১০টি পদই শূন্য, ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক (এফপিআই) ১৩টি পদের মধ্যে ৪টি পদ শূন্য, পরিবার কল্যাণ সহকারী ৬৯টি পদের মধ্যে ৪৮টি শূন্য, আয়া ১৩টির মধ্যে ৮টি শূন্য, অফিস সহায়ক ১টি পদ শূন্য।
এবিষয়ে ফরদাবাদ গ্রামের দাসপাড়ার রাম দাস (৪০) হলেও এই বয়সে ৬ সন্তানের জনক তিনি। জন্মনিয়ন্ত্রন সম্পর্কে তার নূন্যতম কোন ধরনা নেই। কারণ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠ কর্মীরা আসেন না তার বাড়িতে। একান্ত প্রতিক্রিয়ায় রাম দাস বলেন, “বেশি ছেলে মেয়ে হওয়ায় সংসারের অভাব আর যায় না। কেউ যদি আমারে পরামর্শ দিত তইলে আর ৬ বাচ্চা নিতাম না। মাঠ কর্মী ও পরিবার পরিকল্পনা কারে কয় আমি জানিনা।”
অনুসন্ধানে জানা যায়, অধিকাংশ পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ), পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউবি), ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক (এফপিআই), কমিউনিটি ক্লিনিকের হেল্থ প্রোপাইটার (সিএইচসিপি) ও চিকিৎসক দায়িত্বরত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বসেন না নিয়মিত। অনেকে সপ্তাহে একদিন এসে আবার কেউ কেউ মাসে একদিন এসে স্বাক্ষর দিয়েই তার দায়িত্ব পালন করে। বাড়িবাড়ি গিয়ে গৃহবধু ও পুরুষদের জন্ম বিরতিকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি ও সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে পরামর্শ ও জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী বিতরণের কথা থাকলেও তারা তা করছে না। অথচ অফিস থেকে প্রতি মাসে তাদের নামে বরাদ্দকৃত জন্মবিরতি করণ সামগ্রী উত্তলনে করে বিভিন্ন ফার্মেসিতে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহে একদিন একজন ডাক্তার চিকিৎসা দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে আসছেনা। হেল্থ প্রোপাইটাররা যথাসময়ে ক্লিনিক খোলছেনা। ঔষধ বিতরণ না করে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে না এসে মাস শেষে স্বাক্ষর দিয়ে বেতন উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে তারা হলেন পাহাড়িয়াকান্দি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের (এফডব্লিউভি) মানফুজা বেগম থাকেন গাজীপুরে, সোনারামপুরের (এফডব্লিউভি) ইয়াসমিন আক্তার থাকেন নরসিংদীতে, কল্যাণপুরের শওকত জাহান থাকেন ঢাকায়, দরিয়াদৌলতের ছাবেকুন্নাহার ও নাসরিন বেগম থাকেন ঢাকায়, তাতুয়াকান্দি-হায়দরনগরের রাশিদা আক্তার থাকেন ছলিমাবাদে ও আনোয়ারা বেগম থাকেন ঢাকায়, তেজখালীর মাহিয়ূন নাহার থাকেন নরসিংদীতে, বাহেরচরের নাজরীন আক্তার থাকেন নরসিংদী। ফরদাবাদের ভিজিটার ফেরদৌসি আক্তারের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলা ও টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়াও অফিস ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তেজখালীর পরিবার কল্যাণ পরিদর্শীকা মাছুমা জিন্নাত, দরিয়াদৌলতের শাহ আলম, দরিকান্দির নিলুফা বেগম, আইয়ূবপুরের আমেনা খাতুন, সোনারামপুরের এফপিআই গোলাম মোস্তফা, রূপসদীর এফডব্লিউএ সালেহা খাতুন, ভুরভুরিয়ার ফাতেমা খাতুন, পাহাড়িয়াকান্দির কানিজ রৌশন আরা, কামরুন্নাহার বেগম, বাঞ্ছারামপুরের ভিজিটর ফাতেমা আক্তার।
পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক উজানচরের জাকির হোসেন, আইয়ূবপুরের মোঃ হাসান, দরিয়াদৌলতের আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফরদাবাদের মোঃ এমরান, বাঞ্ছারামপুরের আলী আকবর সবুজ, রূপসদীর শাহাবুদ্দিন জালালী, পাহাড়িয়াকান্দির সাকিরুন মিয়া, সোনারামপুরের গোলাম মোস্তফা নামেমাত্র দায়িত্ব পালন করে মাস শেষে বেতন উত্তোলন করছেন। তাদের কেউ কেউ এলাকায় রাজনীতি ও ব্যবসার সাথে জড়ির থাকলেও বড় কর্তাদের ম্যানেজ করায় তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেননা।
এব্যাপারে সোনারামপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের (এফডব্লিউভি) ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “নরসিংদীতে আমার স্বামী-সন্তান থাকে, আমার বাচ্চা ছোট তাই প্রায় সময় আমি নরসিংদীতে আসি। আমি এলাকায় থাকি না এই অভিযোগটি মূলত কিছু গাঞ্জাখোররা দিবে। কারণ আমি থাকলে ঐখানে কেউ গাঞ্জা খাইতে পারে না।”
এব্যাপারে পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শীকা মানফুজা বেগম বলেন, “আমার স্বামী গাজীপুরে বাড়ি করেছে এবং আমার সন্তানরা পড়াশোনা করে তাই গাজীপুরে থাকি। বাঞ্ছারামপুর থেকে বদলীর প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।”
এবিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাঞ্ছারাপুর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা একেএম সেলিম ভূইয়া অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি কোন অনিয়মের সাথে জড়িত না। আমার যেসব কর্মীরা দায়িত্বে অবহেলা কিংবা অনিয়ম করে জানা মাত্রই তাদের বিরুদ্ধে শোকজসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেই। ফাঁকিবাজির সুযোগ দিয়ে কর্মীদের কাছ থেকে আমার বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
এব্যাপারে বাঞ্ছারাম উপজেলা  নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিয়াকত আলী সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি বলেন, আমি বিষয়টি এর আগে কেউ আমাকে জানায়নি, আমি খোজঁ খবর নিয়ে দেখতে ছি। যদি কোন ধরনের দূর্ণীতি মূলক  কর্মকান্ড হয়ে থাকে তাহলে আমি অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা নিব।