চার লাখেরও বেশি শিক্ষক প্রশিক্ষণই পাননি
নিজস্ব প্রতিবেদক : সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মোট শিক্ষক আছেন চার লাখ ৬৮ হাজার ৯৪৩ জন। কিন্তু পাঁচ বছরে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পাঠদানের বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মাত্র ৬০ হাজার ৭৭০ জন শিক্ষক। এই প্রশিক্ষণও মাত্র তিনদিনের। চার লাখ আট হাজার ১৭৩ জন শিক্ষক এখনও সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির উপর বিষয়ভিত্তিক কোন প্রশিক্ষণই পাননি। গত ডিসেম্বরে শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো ‘সেসিপ’ প্রকল্পের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া যায়।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা ও শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ আউয়াল সিদ্দিকী বলেন, ‘আসলে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির উদ্যোগ সফল হয়নি। শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারছেন না, যথাযথ প্রশিক্ষণও পাচ্ছেন না। আবার শিক্ষার্থীরাও সঠিকভাবে উত্তর না লিখে নম্বর পাচ্ছে, এটা চলতে পারে না। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির বিষয়ে পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। কারণ এই ব্যবস্থা বুঝতে না পেরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয় নোট-গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে শিক্ষকদের গলদ নিরসনের নামে প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষকদের তিনদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, তা বাড়িয়ে এক মাস করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতি, অদক্ষতা ও অনৈতিক তৎপরতার কারণে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের অর্ধেকের বেশি, প্রায় একশ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ‘সেসিপ’ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। সেসিপ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশের শিক্ষকদের সৃজনশীল বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে না জেনে প্রশিক্ষণের নামে ঘন ঘন কর্মশালা, দেশ-বিদেশে আনন্দ ভ্রমণ ও সভা-সেমিনার করে ঋণের অর্থ ব্যয়ের মহাযজ্ঞের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে কয়েকবার আবাসিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দেশব্যাপী মাঠপর্যায়ের যেসব শিক্ষক সরাসরি শ্রেণী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সেই ধরনের শিক্ষকরা এই সুবিধা খুব একটা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্যই অবাস্তবায়িত থেকে যাচ্ছে বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
সেসিপ প্রকল্পের ‘জয়েন্ট প্রোগ্রাম ডিরেক্টর’ (জেপিডি) আবু সাঈদ শেখ (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, ‘প্রশিক্ষণের মেয়াদ একমাস বা দেড় মাসে উন্নীতকরণের বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তা চূড়ান্ত হয়নি।’
এদিকে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’র (সেসিপ) দলিলে স্থানীয় প্রশিক্ষণ খাতে পরীক্ষা পদ্ধতি উন্নয়ন বিষয়ে দুই লাখ ২৪ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম চলমান। এ খাতে ১৮৩ কোটি পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকার সংস্থান রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সারাদেশের মোট ৬০ হাজার ৭৭০ জন শিক্ষককে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি বিষয়ে তিন দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে এবং চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। প্রশিক্ষণ খাতে অবশিষ্ট বরাদ্দ রয়েছে ১৪৯ ৬৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা। কিন্তু প্রকল্পের বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে আগামী এক বছরে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ চারভাগের একভাগ ব্যয় করা যেতে পারে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। কারণ গত তিন বছরে প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক প্রশিক্ষণের পরিধি বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে আবু সাঈদ শেখ বলেন, ‘আগে যারা এই প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন তারাই এটা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি দ্রুত প্রশিক্ষণের মেয়াদ ও পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
তবে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশের সকল শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে সেসিপর জেপিডি বলেন, ‘আশা করছি এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে বরাদ্দকৃত অর্থও ব্যয় করা সম্ভব হবে।’
মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীনে। সেসিপ প্রকল্পের প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না পারার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এই প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধি অনুমোদন পেলে আরও শিক্ষক প্রশিক্ষণের আওতায় আসবেন।’
গত বছর মাউশির এক ‘একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনে’ বলা হয়, সারাদেশের সাত হাজার ২৭৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র তিন হাজার ৭১৪টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন। অর্থাৎ ৫১ দশমিক ০৪ শতাংশ শিক্ষক নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। বাকি ৪৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না।