গরীবের রক্ত ঝরানো টাকা দিয়ে বড়লোকিপানা করেন : প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক : গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রতি ইঙ্গিত করে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গরীবের হাড়-মাংস ও রক্ত ঝরানো টাকা দিয়ে যিনি বড়লোকিপানা করেন, তার আবার দেশের প্রতি ভালবাসা থাকবে কোথায় থেকে? দেশপ্রেম থাকবে কীভাবে? গরীব-দুখী মানুষের কাছ থেকে সুদ নিয়ে তাঁর এখন অনেক টাকা। কিন্তু সরকারকে কোন ট্যাক্স দেননি।
ওই ব্যক্তির ফিক্সড ডিপোজিডে থাকা বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে আসল তারও কোনো হিসাব উনি দিতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। আজ বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা বলেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে এ সংক্রান্ত প্রশ্নটি উত্থাপন করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এ কে এম মাঈদুল ইসলাম। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, এমন কিছু লোক আছে তারা হাজার দোষ করুক-পাপ করুক, তাদের দোষ যেন দোষই না। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। অথচ আমাদের পান থেকে চুন খসলে কতো কথা, কতো লেখা হয়। জানি না তাদের বাচন ভঙ্গি বা কার্যক্রমের মধ্যে কী ম্যাজিক আছে? কিন্তু উনি সেই কথামালা দিয়ে অর্থ-সম্পদ নিজের করে একটা অবস্থান করে নিয়েছেন।
ওয়ান ইলেভেনের সময় একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদককে সঙ্গে নিয়ে নতুন দল গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুদখোরের ডাকে দেশের জনগণ সাড়া দেয়নি। জনগণ তাঁকে প্রত্যাখান করেছেন।
তিনি বলেন, ওনাদের কাছে থাকা টাকা, আমার গরীব-দুঃখী মানুষের সপ্তাহে সপ্তাহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকা। তারা (ঋণ গ্রহীত) ঘাম-রক্ত ঝড়িয়ে টাকা কামাই করেছে, সেখান থেকে বিশাল অংকের সুদ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, তাঁকে (ড. ইউনুস) গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে সরকার সরায়নি। উনি নিজেই আদালতে মামলা করে হেরে গিয়ে এমডি পদ খুইয়েছেন। আর মামলায় হেরে যাওয়ার পর তাঁর যত ক্ষোভ যেন আমার ওপর। লবিষ্টের মাধ্যমে বিদেশের অনেকের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করলেন। এমনকি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনকে দিয়েও আমাকে ফোন করিয়েছিলেন। তাঁকে বলেছি, উনি আইন ভঙ্গ করে পদে ছিলেন। নিজে মামলা করে পদ খুইয়েছেন।
ড. ইউনুসকে উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, উনি কী আমাকে এক কাপ চা খাইয়ে গ্রামীন ফোনের লাইসেন্স নিয়েছিলেন, নাকি আমি নিজে তাঁকে চা খাইয়ে লাইসেন্স দিয়েছিলাম তা দেশবাসীকে বলুন।
তিনি আরো বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের লাইসেন্স নেওয়ার সময় উনি বলেছিলেন, লভ্যাংশের ৩০ ভাগ গ্রামীণ ব্যাংকে যাবে, সেই টাকা দিয়ে জনগণের কল্যাণ করা হবে। আমরা তাঁর কথায় বিশ্বাস করে লাইসেন্স দিলাম। কিন্তু পরে তিনি গ্রামীণ ফোনকে নিজের সম্পত্তি বানালেন। ৩০ ভাগ শেয়ার নিজের নামে রেখে বাকি শেয়ার উনি বেচে দিলেন। গ্রামীণ ফোনের লভ্যাংশ জনগণকে তো দেননি, উল্টো এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ তাঁর ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা, অথচ একটি টাকা উনি সুদ দেননি। গ্রামীণ ব্যাংক সুদমুক্ত ছিল এটা ঠিক, কিন্তু এই ব্যাংকের নাম ব্যবহার করে উনি যে আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তো আর সুদমুক্ত না। সেই সুদ কেন সরকার পাবে না? সেসব প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স তারা কেন দেবে না? আর ফিক্সড ডিপোজিটে থাকা এতো টাকা কোথায় থেকে এসেছে সেই হিসেবেও তো দিতে পারেননি। এখানে অর্থমন্ত্রী আছেন উনিই দেখবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন। আমি বলতে গেলেই তো আমার বিরুদ্ধে শুরু হবে নানা কথা।
দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংকের পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের প্রসঙ্গ তুলে ধরে শেখ হাসিনা আরো বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনেই রয়েছে ৬০ বছরের বেশি কেউ এমডি পদে থাকতে পারবে না। উনি (ড. ইউনুস) সত্তর বছর বয়সেও এমডি পদে বহাল ছিলেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও আমার উপদেষ্টা ড. গরহর রিজভী তাঁর কাছে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে যেহেতু বয়সের কারণে এমডি পদে থাকতে পারেন না, তাই ওই পদ ছেড়ে দিন আমরা আপনাকে ওই ব্যাংকের ‘এ্যাডভাইজার ইমেরেটাস’ করব। উনি না মেনে ড. কামাল হোসেনের পরামর্শে আদালতে গিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। মামলায় হেরে গিয়ে এমডি পদ হারালেন। আর সেই ক্ষোভ পড়ল আমাদের ওপর, পদ্মা সেতুর ওপর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ হারানোর পর উনি দেশে-বিদেশে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা শুরু করলেন। একটি স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদককে নিয়ে উনি (ড. ইউনুস) বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করলেন। হিলারী ক্লিনটনের সঙ্গে লবি করলেন। এরপর কোন অর্থ ছাড় না করেই পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র এনে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিল। মার্কিন গোয়েন্দা দিয়ে আমারসহ আমার ছেলে-মেয়ে, বোন, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের বিষয়ে নানাভাবে তদন্ত করা হলো- এতটুকু দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া যায় কি না। এতো কিছু করেও তারা কোন প্রমাণ করতে পারেনি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের মনের জোর ও সততা ছিল বলেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বলেছিলাম, বিশ্বব্যাংকের টাকায় আর পদ্মা সেতু করব না। যারা কান কথা শুনে একটা উন্নয়নের প্রকল্পের টাকা বন্ধ করে দেয়। পদ্মা সেতু বন্ধ হওয়ায় তারা তো মহাখুশী। কিন্তু আমরা সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। এখন আমরা নিজের অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করছি।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের অপর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে তাঁর সরকার গৃহীত ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এক সময় ধারণা ছিল ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করতে পারবে। তিনি নিজেও সেটি বিশ্বাস করতেন বলে ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ে অনেক সহযোগিতাও করেছেন। কিন্তু দেখা গেছে, ক্ষুদ্র ঋণের সুদ ও চক্রবৃদ্ধি সুদের হার এত বেশি যে, এই চক্রে পড়ে মানুষ স্বাবলম্বী হওয়ার বদলে নি:স্ব হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকে সাপ্তাহিক সুদও আবার ঋণ দেওয়ার সময় অগ্রিম কেটে নেওয়া হয়েছে এবং সেটি পরিশোধ করতে গিয়ে আবারও ঋণের জালে গরিব মানুষকে আটকে ফেলা হয়েছে। এর ফলে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ মানুষকে নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনে ঘর-বাড়ি হারিয়ে গ্রামছাড়া হতে হয়েছে, অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন। এই অবস্থা আমি জানতাম। এ কারণেই ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর দারিদ্র্যবিমোচনের লক্ষ্যে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প নেই। আর দেশের গরিব মানুষ যাতে কেবল ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না থাকে, নিজেদের সঞ্চয়ে নিজেরাই স্বাবলম্বী হতে পারে- সে লক্ষ্য নিয়েই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রকল্পও নিয়েছি।
স্বতন্ত্র সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজীর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অনেক ঝড়ঝাপটা মোকাবেলা করেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। বিশেষ করে আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতে জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য এবং মানুষ পুড়িয়ে হত্যার মতো ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই এগুতে হয়েছে। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা ও এডিবির ৯৪-৯৫ ভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে। দেশে যে সুশাসন আছে, এতেই প্রমাণ হয়। আমরা যে লক্ষ্য নিয়েছি, তা পূরণ করতে পারবো। সেই আত্মবিশ্বাস আমাদের রয়েছে।
জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা চট্টগ্রামে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও কক্সবাজার থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অগ্রগতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পায়রায় একটি বন্দর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। সেখানেও একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ আমরা করতে পারবো।