বৃহস্পতিবার, ১২ই জানুয়ারি, ২০১৭ ইং ২৯শে পৌষ, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু

AmaderBrahmanbaria.COM
আগস্ট ১৫, ২০১৬

কায়ছার আলী : আমেরিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটা গল্প প্রচলিত আছে। এক বিশাল দ্বীপকে নিয়ে গল্পটি তৈরী। এই দ্বীপে প্রায় ৫লাখ লোকের বাস। দ্বীপটির নিরাপত্তা ঝুঁকিপ্রকট। দ্বীপবাসীরা দেখল উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে আকাশ থেকে নেমে আসছে। তারা একে অনুসরণ করল এবং একটি বড় ফাঁকা মাঠে তা এসে থামল। অর্থাৎ সেটাই ছিল একজন দেবদূত। চারিদিকে হাজার হাজার মানুষ এসে জমা হলেন। তাঁরা তার সাথে কথা বলতে চাইলেন। দেবদূত বললেন, “তোমাদের এত লোকের সঙ্গে তো আমার কথা বলা সম্ভব নয় বরং তোমরা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দাও আমি তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবো ও কথা বলব। তারা তিনজন প্রতিনিধি নির্বাচন করে দিলেন। একজন বৃদ্ধ শতায়ু, আরেকজন আধুনিক ফিটফাট কেতাদুরস্ত, অন্যজন সাদাসিধা বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মনে হয়। প্রথমে বৃদ্ধ আসলেন দেবদূত কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলেন “এখন থেকে আটচল্লিশ ঘন্টা পর তোমদের এই দ্বীপে জলোচ্ছ্বাস হবে এবং বাড়িঘর, সহায় সম্পদসহ তোমাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

তুমি এখন কি করবে? বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, “আমি জীবনে অনেক পাপ করেছি, এখন বয়স হয়েছে আর বেশিদিন বাঁচবো না এই সময়ে কান্নাকাটি করে বিধাতার দরবারে মাফ চেয়ে নেব। যাতে পরকালে আমার ভাল হয়। দ্বিতীয় ব্যক্তি একই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “জীবনে আমি অনেক কিছুই ভোগ করেছি এখন যতটুকু সময় অবসর আছে খাওয়া-দাওয়া ফূর্তি ইত্যাদি সেরে নেব। মৃত্যুর পর কি পাব না পাব তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এবার তৃতীয় ব্যক্তি একই প্রশ্নের উত্তরে চিন্তা করে বললেন (৪৮ঘন্টাকে মনে মনে মিনিট ও সেকেন্ড হিসেব করে নিলেন) “এখনও ১লক্ষ ৭২ হাজার ৮০০ সেকেন্ড সময় আছে আমি আমার দ্বীপের ৫ লাখ লোককে সংগঠিত করে তাদের ১০লাখ হাতকে কাজে লাগাব এবং জলোচ্ছাস আসার আগেই দ্বীপের চারিদিকে এমন বাঁধ নির্মাণ করবো যাতে জলোচ্ছ্বাসের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে না পারে এবং একটি লোকেরও যেন জান ও মালের ক্ষতি না হয়।” দেবদূত তার কথা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমি তোমার সাথে আছি।

” ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব-অনটন, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বিরোধীদের যে জলোচ্ছ্বাস তার মোকাবেলার জন্য বাঁধ তৈরিতে উদ্বুদ্ধ ও কাজে লাগনো হচ্ছে নেতা বা রাজনীতিকের কাজ। আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করাই নেতার সাফল্য। এমন মহান নেতাকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। টুঙ্গিপাড়ায় চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু আর কোনদিন কথা বলবেন না, আর কখনও তার কন্ঠে উচ্চারিত হবে না দুখিনী বাংলা মায়ের দাবি আদায়ের কথা। যাব সমস্ত বুক জুড়েই ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র যার অপেক্ষায় ছিল ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট ভোরের সূর্য, সেদিন প্রতীক্ষায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ছ্ত্রা-ছাত্রী ও শিক্ষকগণ এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে বিশ্বকবি লিখেছিলেন-“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।” ঘৃণ্য ঘাতকেরা স্টেনগানের একঝাঁক বুলেট দিয়ে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয় এক মহান রাষ্ট্রনায়ককে, এক নিয়তি নির্মাতাকে, যুগশ্রষ্টাকে। জাতির পক্ষ থেকে দেয়া এক অমোচনীয় কালিমা যা কখনো অপসৃত হওয়ার নয়। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের।

কোটি কোটি দেশপ্রেমিকের পুত পবিত্র ধারায় øাত হয়ে উথ্রিত এই বাংলাদেশটাই তাঁর স্মৃতির মিনার। নদী মেঘলা, শস্য শ্যামলা এই মাতৃভূমিকে তিনি ধ্যানে, প্রাণে তাঁর প্রথম ও শেষ পবিত্র ভূমি বলে নির্ধারণ করেন। জীবনেও মরণে বাংলাদেশকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে। এই মৃত্তিকা পবিত্র থেকে পবিত্রতর হয়েছে তাঁরই বুকে ভেজা তাজা রক্তে। অবিনাশী আপন কীর্তি সমূহ পিছনে ফেলে তাঁর জীবনে রথ দিগন্তে পৌঁছে গেলে এখানে রচিত হয়েছে তাঁর অন্তিম শয়ান। হৃদয় বিদারক মমস্পর্শী ঘটনা চিরদিনই মনে থাকে। একটি আত্মা হুতি একটি জনপদকে আলোড়িত করতে পারে, একটি দুর্ঘটনা (সড়ক,নৌ,বিমান,ট্রেন) মানুষের অনুভুতিতে কয়েকদিনের জন্য ব্যথা বা ক্ষতের সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু একজন সকল রাষ্ট্রনায়ক, সরকার প্রধান, অবিসংবাদিত, ক্যারিজম্যাটিক বা সম্মোহনী শক্তি সম্পন্ন নেতার হত্যাকান্ড অথবা শাহাদত প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যুগের পর যুগ একটি দেশ, জাতি বা রাষ্ট্রকে অনুপ্রানিত করে সেই অনুপ্রেরনার আভায় উদ্ভাসিত বাংলার আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এক নক্ষত্র চিরভাস্কর প্রতিভাধরের নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি বাঙ্গালীর হাজার বছরের চিরন্তন সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিশাল অধ্যায়ের শিরোনাম। এই দেশ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসনামলে অনেক রাজধানী ছিল। যেমন- মুুর্শিদাবাদ, গৌড়, একডালা, কর্ণসুবর্ণ, কমান্ত বসাক, পুন্ডনগর, পাটালিপুত্র, সোনারগাঁও, বিক্রমপুর, লক্ষনাবর্তী, পান্ডুয়া, নদীয়া বা নবদ্বীপ। কিন্তু ঢাকাকে রাজধানী করে এই ভূ-খন্ডে স্বাধীন প্রথম মুসলিম বাঙালি শাসক শেখ মুুজিবুর রহমান। দেশী এবং বিদেশী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁর রয়েছে সংগ্রামের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার ফলে বিদেশী শাসকদের আমরা শাসিত হয়েছি। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে নদী বা পুকুরে গিলে খায় আমাদের অবস্থা ঠিক সে রকমই হয়েছিল। শত শ্রদ্ধা রেখেই লিখছি হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী যা আমাদের দিতে পারেনি সেই মহান স্বাধীনতা তিনি আমাদের এনে দিয়েছেন আর এটা সম্ভব হয়েছে তার সম্মোহনী নেতৃত্বের কারণে। ক্যারিজমা বা সম্মোহনী হচ্ছে নেতা ও তার অনুসারীদের মধ্যে একটি আবেগময় বন্ধন।

অন্যভাবে বলা যায় ক্যারিজমা হচ্ছে কোন ব্যক্তির নেতৃত্বের প্রতি চরম ভক্তি বা আসক্তি এবং তার অন্যান্য গুণাবলীর সহিত ব্যক্তিগত আসক্তি। যখন কোন সমাজে বা যে কোন দেশে নানাবিধ কারণে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর সংকট দেখা দেয় তখন ক্যারিজমা সুলভ নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে। এই নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী চেতনা এনে দেয় যা স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, অদম্য সাহস ও অকুণ্ঠ আত্মত্যাগের ইতিহাস নিয়ে দেশে-বিদেশে সর্বত্র গবেষণা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ শে মার্চ ২০০৪ থেকে প্রচারিত বিবিসি বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপে নির্বাচিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাঙালির তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ই এপ্রিল ২০০৪ “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি” হিসেবে তাঁর নাম প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের জীবনে ১২ বছরের অধিক কেটেছে কারাগারে, জীবনের অর্ধেক কেটেছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে, পুরো জীবন গেছে স্বাধীনতা নির্মাণে।

বাংলাদেশ এর নামকরণ, ছাত্রনেতা হিসেবে কৃতিত্ব, প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিত্ব লাভ, আওয়ামী লীগের জন্ম থেকে সম্পৃক্ততা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতা, ছয় দফা দাবি পেশ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধু উপাধি, ৭০-এর নির্বাচন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান, মৃত্যুমুখে জেলখানায় বন্দি জীবন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, মাত্র সাড়ে ৩ বছরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ, জাতির জনক উপাধির ইতিহাসগুলো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আমরা কি জানি ওহপষঁংরাব ফবসড়পৎধপু – র কথা। ৭ই মার্চের ভাষনে তিনি বলেন, “যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।” গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হল সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের নামে অনেক ভাল চিন্তা ও উদ্যোগ বাতিল হয়ে যায়। শুভ কাজ সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে পিষ্ঠ হয়। ওহপষঁংরাব ফবসড়পৎধপু হল ভাল পরামর্শ ও প্রস্তাব যদি একজনও হয় তাকে মুল্যায়ন করা উচিত।

যে মহান মানুষটি কমপক্ষে একজন লোকের মতামত এবং সর্বোচ্চ লোকের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন অর্থাৎ আপামর জনগণকে জীবন দিয়ে কি রকম ভালবাসতেন তার একটি কথা না লিখে পারছি না। বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট হয়তো বেকায়দায় ফেলতে বা বিব্রত করতে কিংবা সরলভাবে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন Mr. Prime minister what is your qualification? “উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন- – I love my people” এরপর তিনি প্রশ্ন করেন What is your disqualification?” চোখ মুছতে মুছতে প্রতিভাদীপ্ত কন্ঠে বলেন I love them too much  অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় সর্বনাশা কালো রাতের দৃশ্যপট মানসচক্ষে একবার ভেসে উঠলেই শিহরিত হতে হয়। বঙ্গবন্ধুর রক্তমাখা নিথর দেহের সাথে আরো ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, অপর পুত্র শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, ভাই শেখ নাসের ও কর্ণেল জামিলের মৃতদেহ।

অন্য বাড়িতে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ, রিন্টু খানসহ অনেকের লাশ। পরিশেষে সকলের আত্মার শান্তি কামনা করে মনে করছি একটি আর্টিক্যালে বঙ্গবন্ধুর মত মহান ব্যক্তির জীবনী লিখা অত্যন্ত কঠিন। আমার এখনও বার বার আবৃতি করতে ভাল লাগে পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের “কবর” কবিতাখানি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’, বহুমুখী প্রতিভার নোবেল জয়ী বিশ্ব্কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গাইতে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি এবং হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুনতে তেজদীপ্ত, বজ্রকণ্ঠে ৭ই মার্চের কালজয়ী ভাষণ। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

লেখকঃ শিক্ষক, [email protected]
ফরক্কাবাদ এন.আই স্কুল এন্ড কলেজ। বিরল, দিনাজপুর।