ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৫ ইউনিয়নের ১৪টিতেই আওয়ামীলীগ
---
আমিরজাদা চৌধুরী,ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর ও আখাউড়া উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টিতেই জয়ী হয়েছে আওয়ামীলীগ প্রার্থী। একটিতে জিতেছে বিদ্রোহী প্রার্থী। এদিকে ব্যাপক কারচুপিতে শনিবার ভোট হয় এসব ইউনিয়নে। নৌকার ভোট প্রকাশ্যে নেয়া হয়। কোন কোন কেন্দ্রে পুলিশ ও ভোট গ্রহনের দায়িত্ব প্রাপ্তরা নিজেরাই দরজা বন্ধ করে সীল মারেন। অন্তত ১০ টি ইউনিয়নে বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেন। বিজয়নগরের পত্তন ইউনিয়নের আদমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই ইউপি সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় রনক্ষেত্রে পরিনত হয় ঐ এলাকা। সংঘর্ষে আহত হয় ৩০ জন। একজনের পেটে তীরবিদ্ধ হয়। সকাল ১০ টার এ ঘটনার পর বেলা ১ টা পর্যন্ত ঐকেন্দ্রে অবস্থানকরাকালীন ভোট চালু হয়নি। প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে ভোট গ্রহনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলকে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। কেন্দ্রটিতে ঘটনার পরপর ছুটে আসেন জেলা প্রশাসক ড: মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ও পুলিশ সুপার মো: মিজানুর রহমান। তারাও অবস্থান নেন প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষের সামনে। হামলাকারীরা কেন্দ্র থেকে ব্যালেট বই ও সীল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান- সকাল ১০টায় আদমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যায় ডালিম নামের এক যুবক। রতন ভাইকে নৌকায় ভোট দিন লেখা গেঞ্জি পরিহিত হারুন নামের এক লোক তাকে বাঁধা দেয়। একপর্যায়ে হারুন ডালিমকে ঘুষি মারে। শুরু হয় হৈহুল্লা। মূহুর্তের মধ্যে কেন্দ্রের সামনে দুই ইউপি সদস্য প্রার্থী আবদুল হাকিম ও শিশু মিয়ার সমর্থকরা ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্র সংলগ্ন চান্দুরা-আখাউড়া সড়কে চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এ সময় পুলিশের ছোঁড়া রাবার বুলেটের শব্দে কেন্দ্রের ভিতরে ও বাইরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দেড় ঘন্টা স্থায়ী সংঘর্ষে তীরবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন মস্তু ভূইয়ার ছেলে জাকির ভূইয়া (৩২)। এ ছাড়া উভয় পক্ষের আরো ৩০ জন লোক আহত হন।এই সুযোগে নৌকার সমর্থকরা জোর করে ভোট ছাপাতে শুরু করে। দস্তাদস্তি করে তারা সহকারি প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের কাছ থেকে ৬টি ব্যালট বই ও ৯টি সীল ছিনিয়ে নেয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার। তাদের সঙ্গে আসে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের স্ট্রাইকিং ফোর্স । ঘটনার আগ পর্যন্ত এ কেন্দ্রে ২১১৮ ভোটের মধ্যে ৯’শ ভোট কাষ্ট হয়েছে। দুপুর ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকজনকে ভোট গ্রহন বন্ধ করে অসহায় ভাবে বসে থাকতে দেখা গেছে। আরেকটি কক্ষে ভীত সন্ত্রস্থ অবস্থায় ভোট গ্রহনের দায়িত্বে থাকা লোকজন ব্যালেট বাক্সসহ আনুষাঙ্গিক নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে বসে থাকেন। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার লুৎফুর রহমান চৌধুরী বলেন হঠাৎ করে বাইরে গন্ডগোল শুরু হয়। গুলির শব্দ পাই। এরপর আতঙ্কিত হয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকি।
এদিকে সকাল ৮ টায় ভোট গ্রহন শুরুর এক ঘন্টা পরই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিএনপি প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ আসতে শুরু করে। অভিযোগ আসে ব্যালেট পেপার ভোটারদের হাতে না দেয়ার। বুধন্তি ইউনিয়নের কাজী রফিকুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোশাররফ হোসেন খান অভিযোগ করেন এই কেন্দ্রে জনগন ভোট দিতে পারছেনা। চেয়ারম্যানের ব্যালেট নৌকার এজেন্ট দুলাল মিয়া নিয়ে যাচ্ছে। এই কেন্দ্রের ২ নম্বর বুথে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর এজেন্ট নাসির উদ্দিন খান বলেন- দুলালের নেতৃত্বে নৌকার লোকজন ভোটারদের হাত থেকে ব্যালেট কেড়ে নিয়ে প্রকাশ্যে নৌকায় সীল মারছেন। এই ইউনিয়নে বিএনপি প্রার্থী মো: জিয়াউদ্দিন খান নয়ন অভিযোগ করেন শশৈ ইসলামপুর,আলীনগর,বারঘড়িয়া,বুধন্তি,সেমরা,কেনাসহ সবকটি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে এবং চেয়ারম্যানের ব্যালেট কেড়ে নেয়া হচ্ছে। তিনি এই পরিস্থিতিতে সোয়া ১০ টার দিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা দেন। বিষ্ণপুর ইউনিয়নের দুলালপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতা বিভিন্ন বুথে গিয়ে নৌকার ভোট প্রকাশ্যে নেয়ার কথা বলেন। তারা বলেন এখানে নৌকার ব্যাপারে সবাই একমত। তাই ওপেন নেয়ার কথা বলছি। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো: দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে আসেন একটি বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মাহমুদুন নবী। তিনি প্রিজাইডিং অফিসারকে বলেন-আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরে। এখন আমি কি করবো। আমার সামনে তারা সীল মারবে কি করে। এরপরই প্রিজাইডিং অফিসার ষ্ট্রাইকিং ফোর্স আসার জন্যে ফোন করেন। গনেশামপুর দারুল উলুম মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দিতে পারেননি অনেকেই। সকাল ১১ টায় কেন্দ্রে প্রবেশের মুখে এগিয়ে আসেন বৃদ্ধা সৈয়দা বানু। তিনি বলেন তাকে পুলিশ লাঠি দিয়ে গুতা মেরে বের করে দিয়েছে। আরেক ভোটার হনুফা বলেন এমন আলামত জীবনে দেখিনি। কোন সময় কেন্দ্রের দরজা বন্ধ করতে দেখিনি। কেন্দ্রটিতে গিয়ে দেখা গেছে একেবারে ফাকা। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আবুল কালাম আজাদ তার কক্ষে ফোনে খোশ গল্পে মত্ত। পুলিশ-আনসার সদস্যরা শুয়ে বসে আছেন পাটিতে। কেন্দ্রের একটি বুথে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মোনায়েম চৌধুরী ব্যালেট বই তার পকেটে ডুকিয়ে বসে থাকেন। প্রিজাইডিং অফিসার তার ব্যালেট বই কই বলার পর সে পকেট থেকে সেগুলো বের করে। প্রিজাইডিং অফিসার তাকে বলেন দেখেননাই সাংবাদিক এসেছে। বুথে অবস্থান করতে দেখা যায় স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা হামদু মিয়াকে। এ কেন্দ্রটি বন্ধ করে ভোট ছাপানোর অখিভযোগ করেন বিএনপি প্রার্থী অলিউল্লাহ ভূইয়া। তিনি বলেন চৌধুরী বাড়ি,চতুরপুর,দুলালপুর,রূপা,গনেশামপুর কেন্দ্রে প্রশাসন ও গুন্ডাবাহিনী ব্যালেটে সীল মেরেছে। আওয়ামীলীগ প্রার্থী জামাল উদ্দিন ভূইয়া এর নেতৃত্ব দেন। বিজয়নগর উপজেলার ১০ ইউনিয়নের বেশীরভাগ কেন্দ্রই ছিলো ভোটার শূন্য। ১১ টার মধ্যেই ভোট গ্রহন সারা হয়ে যায়। আখাউড়া উপজেলার ৫ টি ইউনিয়নেও চলে একই ধাচের অনিয়ম। ফলে সকাল থেকে একে একে বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষনা দিতে থাকেন।
আখাউড়ায় আওয়ামীলীগ মনোনিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপির ৫, জাতীয় পার্টির ৫ ও ১জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেন। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১২ টার মধ্যেই তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। বেলা ১১টায় মোগড়া ইউনিয়নের উমেদপুর প্রা: বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৪/৫টি ককটেল বিস্কোরিত হলে কিছু সময়ের জন্য ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে। নির্বাচনী সহিংসতায় দুইজন আহত এবং কয়েকটি মাইক্রো বাসের কাচ ভাংচুর হয়েছে।আহরা হলেন দক্ষিণ ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর কেন্দ্রের বাবুল মিয়া (৪০) ও মনিয়ন্দ ইউনিয়নের তুলাই শিমুল কেন্দ্রের শাহাদাত হোসেন (২২)। এছাড়া রামধনগর সরকারী প্রা: বিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল ভোটের ছবি তুলতে গেলে এক সাংবাদিকের ক্যামেরা নিয়ে যায় এক পুলিশ সদস্য। পরে ক্যামেরায় ছবি মুছে ক্যামেরাটি ফেরত দেয়। সকাল ১০টায় দক্ষিণ ইউনিয়নের আব্দুল্লহপুর কেন্দ্র থেকে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে চেষ্টা করে দুবৃত্তরা। এসময় দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এত বাবুল মিয়া (৪০) নামে এক ভোটার আহত হয়। সকাল ৯টায় ৫০/৬০ জনের একদল যুবক মনিয়ন্দ ইউনিয়নের তুলাই শিমুল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রবেশ করে ভোটারদেরকে নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বলে। এসময় তারা জোর করে ভোটারদের কাছ থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শী মোস্তাফা মিয়া বলেন, সকাল ৯টার দিকে ৩/৪ টি মাইক্রো, ১টি প্রাইভোট কার ও ৪/৫টি মোটর সাইকেল নিয়ে বহিরাগত ৭০/৮০ জন যুবক ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে জোর পূর্বক ভোটারদের কাছ থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারতে থাকে। এসময় নারী ভোটাররা ভয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যায়। ব্যালট পেপার দিতে রাজি না হওয়ায় শাহাদাত হোসেন (২২) নামে এক ভোটারকে পিটিয়ে আহত করে ওই যুবকরা। এসময় উত্তেজিত জনতা ২টি মাইক্রো বাসের জানালার কাঁচ ভাংচুর করে।
এদিকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বহিরাগত কিছু যুবক মান্দাইল প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঢুকে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ফিরে যাওয়ার সময় উত্তেজিত জনতা একটি মাইক্রো বাসের জানালা ভাংচুর করে।
আখাউড়ার কয়েকটি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোট কক্ষের ভিতরে নৌকার ব্যাজ পরিহিত যুবকরা আগত ভোটারদের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট পেপারটি রেখে দিয়ে তারা নিজেরাই নৌকা প্রতীকে সিল দিচ্ছে। বেলা সাড়ে বারটায় মনিয়ন্দ ইউনিয়নের তুলাই শিমুল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় একটি বুধ কক্ষে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ব্যালট পেপার নেই। এ ব্যাপারে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার বদরুল ইসলাম বলেন, ওই বুথের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট শেষ হয়ে গেছে। একই কেন্দ্রের ভোটার হাসিনা বেগম (৩৫) বলেন, ভোট কক্ষে গেলে আমাকে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ব্যালট ছাড়া অন্য ২টি ব্যালট পেপার দেওয়া হয়। সকাল ১১টায় হীরাপুর প্রা: বিদ্যালয় কেন্দ্রের মহিলা ভোট কক্ষের ভিতরে পুরুষ ভোটারকে ভোট দিতে দেখা যায়।
আমিরজাদা চৌধুরী
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
০৮.০৫.১৬