আইয়ুব বাচ্চুর অকাল প্রয়াণে যা বলেছেন ‘তারা’
ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে বৃহস্পতিবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মুমূর্ষু অবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে চিকিৎসকরা কৃত্রিমভাবে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর এর মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যকলাপ ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন।
চিকিৎসকরা জানান, আরো আগেই মৃত্যু হয়েছে তার।
এদিকে, বাচ্চুর মৃত্যুতে ‘স্তব্ধ’ সঙ্গিতাঙ্গন। ভেঙে পড়েছেন এই অঙ্গনের অনেক শিল্পীরা। যে মানুষটির গিটারের ঝনাৎকারে বিদ্যুৎ বয়ে যেত সকলের শিরা-উপশিরায়। চিরতরুণ সে মানুষটির কণ্ঠ বন্ধ হয়ে গেলো চিরতরে, তা ভেবেও হাউমাউ করে কাঁদছেন অনেক শিল্পীরা।
‘নগর বাউল’ খ্যাত জেমস বলেন, বাংলা রক সংগীতের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৮০ সালের শুরু থেকেই তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। সুখে-দুঃখে, মান-অভিমানে পথ চলেছি আমরা। প্রায় চল্লিশ বছর একসঙ্গে ছিলাম।
কাল যখন শুনলাম উনি নেই এই কথাটি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাষায় বলে প্রকাশ করার মতো নয়। আপনের চেয়ে আপন ছিলেন বাচ্চু ভাই।
আইয়ুব বাচ্চুর দীর্ঘদিনের বন্ধু এন্ড্রু কিশোর বলেন, মনে মানতে চায় না বাচ্চু নেই। দুজনই যখন অতি সাধারণ ছিলাম, তখন থেকেই আমরা বন্ধু। আমাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল।
আমি, আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, হানিফ সংকেত একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। অনেক মধুর ছিল সেসব দিন। একজন অসাধারণ শিল্পী ছিলেন বাচ্চু। তার মতো গিটার প্রেমিক কখনই দেখিনি। হাতে টাকা থাকলেই গিটার কিনত বাচ্চু। যারা গিটারিস্ট হতে চায়, শিল্পী হতে চায়। তাদের উচিৎ বাচ্চুকে অনুসরণ করা।
‘সোলস’র সদস্য পার্থ বড়ুয়া বলেন, কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আমাকে তৈরি করেছেন। গিটার শিখিয়েছিলেন। গান করতে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। মূলত তিনিই আমার গানের গুরু ছিলেন।
কখনোই ভাবিনি বাচ্চু ভাই এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবেন। উনার মতো গিটারিস্ট এই উপমহাদেশে আর আছে কি না আমার জানা নেই। সংগীতাঙ্গন বড় সম্পদ হারালো। বেশ কষ্ট হচ্ছে এটা মেনে নিতে। বাচ্চু ভাইয়ের মতো শিল্পী আর বাংলাদেশে আসবে কি না, তাতেও সন্দেহ আছে।
আর্ক ব্যান্ড তারকা হাসান বলেন, মানুষের মনে যে সুর বাজে সেই সু্রই কণ্ঠে ধারণ করে ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। নতুন প্রজন্ম তাকে অনুসরণ করবে। মনে রাখবে অনেক দিন। তাকে মিস করবে সবাই। তার সৃষ্টি কর্মে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। আর কখনো তার সঙ্গে দেখা হবে না ভাবলেই মন কেঁদে উঠছে।
আরেক সঙ্গীতশিল্পী শুভ্রদেব বলেন, আইয়ুব বাচ্চুর মতো এমন গায়ক ও কম্পোজার একশ বছরে বাংলাদেশ পাবে কি না সংশয়। তার মতো গিটার বাজাতে এশিয়ার অনেকে জানেন না। তার কম্পোজ ছিল দুর্দান্ত। সব থেকে বড় গুন ছিল, সবার সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করতেন তিনি।
সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, আইয়ুব বাচ্চু আমাকে বড় ভাইয়ের সম্মান দিতেন। বাসায় আসা-যাওয়াও ছিল ভাইয়ের মতোই। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাছাড়া বাচ্চুর জন্যই সঙ্গীতাঙ্গন এগিয়েছে বহুদূর।
তার (বাচ্চুর) সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। গানের কারণেই আমার-ওর গভীরতা। সারাটি জীবন ও ছিল গানের পাগল, গিটারের পাগল। ওর গানগুলো যেমন ভালো, তার চেয়েও ভালো ছিল ওর মন। ওকে এভাবে হারাবো চিন্তাতীত। বাচ্চুদের জন্ম বারবার হয় না। ওর শূন্যতা কাটানো সম্ভব না। সবাই দোয়া করবেন, বাচ্চু ভালো থাকুক।
ব্যান্ডশিল্পী থেকে অভিনয়ে আসা সুমন পাটোয়ারী বলেন, আমি আজ সুমন পাটোয়ারী। আপনারা যে আমাকে চেনেন, তার একটির বড় অবদান হচ্ছে বাচ্চু ভাই। তিনি যদি সাহস না যোগাতেন তাহলে আমি কোনোদিন অভিনয়ে আসতাম না, মিডিয়াতে আসতাম না। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে বলার মতো আমার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। তাছাড়া বাচ্চু ভাই আমাদের শৈশব।
চলচ্চিত্র পরিচালক ও উপস্থাপক দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে আজ এভাবে মিডিয়ার সামনে দাঁড়াতে হবে ভাবিনি। উনার সঙ্গে অনেক স্মৃতি। অনেক গভীর সম্পর্ক ছিল। অনেক পুরনো। ছোটবেলা থেকে উনার গান শুনে, গিটার শুনে, গান দেখে অনুভব করেই বড় হওয়া।
অনেক সময়ই বলেছি, শরীরের দিকে একটু যত্নশীল হন। একটু সাবধানে থাকেন। উনি বলতেন, ধুর দেবো, আমি তোর থেকে ইয়াং। ওই কথাগুলো স্মরণে আসছে।
আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন, আছেন, থাকবেন। তিনি এখনো হারাননি, বেঁচে আছেন। আমরা যারা আইয়ুব বাচ্চুকে চিনি, সারাজীবনই তার গান ধারণ করে, লালন করেই বাঁচবো। তিনি যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিনেত্রী তিশা স্মৃতিচারণ করে বলেন, বাচ্চু ভাইয়ে সঙ্গে তো একদিন দুই দিনের পরিচয় না। অনেক দিনের সম্পর্ক। আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের একজন বড় অবিভাবককে হারালাম।
চিত্রনায়ক ফেরদৌস বলেন, আমার একটা মুভিতে তার প্লেব্যাক ছিল। শেষ যেদিন তার সঙ্গে দেখা হয়, ওইদিন তিনি আমাকে বলেন, হিরো এত সুন্দর একটা গান গেয়ে দিলাম, আর সিনেমাতে এটা কী করলা। যদি পারো গানটি নিয়ে আবার কাজ কইরো, ফুটিয়ে তুইলো।
গায়ক রবি চৌধুরী বলেন, আইয়ুব বাচ্চু ভাই এরিস্ট্রোক্রেট। অত্যন্ত হৃদয়বান। ভালো মনের মানুষ। বাচ্চু কী ছিলেন তা সবাই জানি। তার স্থান পূরণ হওয়ার নয়। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন যেন ওপারে ভালো থাকেন। আর ভাষা নেই। কিছু বলতে পারছি না।
গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর বলেন, আইযুব বাচ্চু সব সময় আমাকে গুরু বলে ডাকতেন। সে এতো বড় মাপের শিল্পী ছিল কিন্তু কোনো অহংকার লালন করতো না। তার চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
তার মতো এমন সজ্জন, অমায়িক, মিশুক লোক দেশে আর কেউ নেই, ছিল না, আসবেও না। তিনি খুবই সহজ সরল প্রকৃতির ছিলেন।
মরদেহে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন যারা
কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছেছে শুক্রবার সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন প্রিয় শিল্পীকে। কেউ আসছেন ফুল হাতে, কেউ গিটার পিঠে ঝুলিয়ে। শেষবারের মতো ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় দিতে হাজির হচ্ছেন অগণিত ভক্ত-অনুরাগীরা।
সময় যত বাড়ছে ততই বাড়ছে ভক্তের সমাগম। হাজারও মানুষের সমুদ্রে পরিণত হয়েছে শহীদ মিনার। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে আইয়ুব বাচ্চুকে। সকাল ১০টা ২৫ মিনিট থেকে শুরু হয়ে এই শ্রদ্ধা নিবেদন চলবে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।
এদিকে, আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসাস, অভিনয় শিল্পী সংঘ, ডিরেক্টরস গিল্ডসহ আরো অনেক সংগঠন। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সূবর্ণা মুস্তাফাসহ আরো অনেকেই। আছেন নানা পেশা, বয়স-শ্রেণির মানুষজন।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। সেখানে জুমার নামাজের পর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মগবাজারে কাজি অফিস গলিতে আইয়ুব বাচ্চুর গান তৈরির কারখানা ‘স্টুডিও এবি কিচেন’-এ শেষবারের মতো তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে।
সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় জানাজা। শেষে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ আবারো স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। সন্তানরা ফিরলে হিমঘর থেকে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেয়া হবে চট্টগ্রামের নিজ শহরে। এরপর পারিবারিক কবরস্থানে শনিবার মায়ের কবরের পাশে আইয়ুব বাচ্চুকে দাফন করা হবে।