যৌন হেনস্তা: ‘মি টু’ ইস্যুতে চুপ ঢাকাই তারকারা
বিনোদন ডেস্ক : কর্মক্ষেত্রে নারীদের অনিরাপত্তা নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা নানা হেনস্তা আর নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। হেনস্তার প্রসঙ্গটি আসলে প্রথমেই আসে শোবিজ জগতের কথা। বলা হয়ে থাকে, এই জগতেই নারীরাই নাকি বেশি হেনস্তার শিকার হন।
অভিনেত্রী, নারী মডেল কিংবা কলাকুশলী, শোবিজ জগতের সঙ্গে যুক্ত সিংহভাগ নারীর তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিংবা স্থায়ী সম্পর্ক তথা বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক পরিচিত পুরুষ তারকাও যৌন হেনস্তার মতো ঘৃণ্য কাজ করে। বিনোদন দুনিয়ায় বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’-এর মতো হলেও তেমন কেউ এই বিষয়ে মুখ খোলেন না।
যৌন হেনস্তার প্রতিবাদে কেউ মুখ খোলেনি, ব্যাপারটা এমনও নয়। বিভিন্ন সময় আলাদাভাবে অনেক অভিনেত্রী প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু ‘একজন সরব তো বাকি সব নিরব’; এমন অবস্থার কারণে কারো প্রতিবাদে আসেনি কার্যকর ফলাফল। তবে চলতি বছরের প্রথম দিক থেকে হলিউডে শুরু হয় যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রাতারাতি এটি মহামারি আকার ধারণ করে। প্রভাবশালী প্রযোজক হার্ভে ওয়াইনস্টেনের বিরুদ্ধে দেড় ডজনের বেশি অভিনেত্রীকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ ওঠার পর মুখ খুলতে থাকেন অন্যরাও। চালু হয় ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’(#Metoo) অভিযান। অভিনেত্রীরা এই প্রতিবাদে অংশ নিয়ে নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা জানানো শুরু করেন।
হলিউডের দেখাদেখি ঘুম ভেঙেছে বলিউডেরও। প্রথম প্রথম উড়ো উড়ো কিছু অভিযোগের কথা শোনা গেলেও মূল ঝড় ওঠে অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্তের অভিযোগের ভিত্তিতে। কিছু দিন আগেই তিনি অভিনেতা নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে হেনস্তার অভিযোগ তোলেন। দশ বছর আগে ‘হর্ন ওকে প্লিজ’ ছবির সেটে তনুশ্রীকে হেনস্তা করেছিলেন নানা; এমন অভিযোগ ওঠার পর গোটা বলিউডে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় শুরু হয়।
তনুশ্রীর সরব হওয়ায় সাহস পান বলিউডের অন্য অভিনেত্রীরাও। একে একে মুখ খুলতে থাকেন অভিনেত্রী ও নারী কলাকুশলীরা, আর তোপের মুখে পড়তে থাকেন বলিউডের নামজাদা অভিনেতা, নির্মাতা, প্রযোজক ও গায়কেরা। নানা পাটেকর থেকে শুরু করে অমিতাভ বচ্চন, সালমান খান, আরবাজ খান, অলোক নাথ, নির্মাতা সুভাষ ঘাই, সাজিদ খান, গায়ক আনু মালিক ও কৈলাশ খের’র মতো তারকাদের নাম জড়ায় যৌন হেনস্তাকারীর তালিকায়। পুরো বলিউডে এখন এই ইস্যু নিয়েই আলোচনা চলছে। হ্যাশট্যাগ মিটু ঝড়ে যেন ম্লান হয়ে গেছে বলিউডের অন্য সব বিষয়।
এদিকে হলিউড ও বলিউডের নারীরা যখন যৌন হেনস্তার প্রতিবাদে সরব, তখন ঢালিউডের তারকারা সব নিরবতা পালন করছেন। চলমান এই ইস্যু নিয়ে কেউই মুখ খুলছেন না। যেন ঢালিউডে যৌন হেনস্তার মতো ঘটনা ঘটেই না!
কয়েক মাস আগে একটি গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন মডেল-অভিনেত্রী ফারিয়া শাহরিন। সেখানে তিনি জানান, শোবিজে অনেক পরিচালক ও প্রযোজক তাকে অশালীন প্রস্তাব দিয়েছে। কাজের বিনিময়ে অনৈতিক সম্পর্ক করতেও বলেছে। যদিও তিনি সেসবে সাড়া দেননি বলে জানান। কিন্তু সাক্ষাৎকারটির পরে বিতর্কের মুখে পড়েন ফারিয়া শাহরিন। অন্য অভিনেত্রীরা তাকে রীতিমত ধুয়ে দেন!
এর আগে ২০১৩ সালে প্রয়াত পরিচালক পিএ কাজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন নায়িকা অমৃতা খান। ফেসবুকে কথোপকথনের সময় অমৃতাকে অশালীন প্রস্তাব দিয়েছিলেন কাজল। সেই সময় বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। তবে অমৃতার পথ ধরে অন্য কোনো অভিনেত্রী এই বিষয়ে মুখ খোলেননি।
এদিকে সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে মুখ খোলেন মডেল-অভিনেত্রী সূচনা আজাদ। তিনি জানান, শোবিজের প্রায় সবাইকেই কাস্টিং কাউচের শিকার হতে হয়। তিনি নিজেও এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন বলে জানান সূচনা। যদিও নির্দিষ্ট করে কারো নাম উল্লেখ করেননি সূচনা, তবে তার মন্তব্যে যৌন হেনস্তার বিষয়টির স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এরকম ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনেক অভিনেত্রীই মুখ খোলেন, কিন্তু অন্যদের নিরবতার কারণে সেগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। শুধু তাই নয়, হেনস্তার বিরুদ্ধে যারাই মুখ খুলেছেন, ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়ে তারা কেবল পিছিয়ে গেছেন। কেননা নির্মাতা-প্রযোজকরা তাদেরকে কাজে নিতে চাননি।
কিন্তু কেন চুপ থাকেন অন্য অভিনেত্রীরা? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যোগাযোগ করা হয় নাটক ও সিনেমার পর্দার কয়েকজন অভিনেত্রীর সঙ্গে। নাম প্রকাশের না করার শর্তে সিনেমার এক অভিনেত্রী বললেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতেও যে যৌন হেনস্তার মতো ঘটনা ঘটে, এটা প্রায় সবাই জানেন। কিন্তু কেউ মুখ খোলেন না। কারণ ক্যারিয়ার নষ্ট হওয়ার ভয় কাজ করে সবার মধ্যে। ধরুন আজ আমি প্রতিবাদ জানালাম, কাল দেখবেন আমার হাতেই কাজ নেই! বরং আমার প্রতিবাদের সুযোগ নিয়ে অন্যরা কাজ লুফে নেবে। তাহলে বলুন, কে চাইবে তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাক?
ছোট পর্দার এক পরিচিত অভিনেত্রী অবশ্য কিছুটা অন্যভাবে কথা বললেন। তার ভাষ্য, শোবিজের ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ‘স্যাক্রিফাইজ’ করতে হয় বলে শুনেছি। তবে আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। তাই জোর দিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।
বিষয়টি নিয়ে একজন সিনিয়র বিনোদন সাংবাদিক ও সিনেমা বিশ্লেষক জানালেন, শোবিজে কাস্টিং কাউচ, যৌন হেনস্তা কিংবা গীভ অ্যান্ড টেক এসব নতুন কিছু নয়। অনেক নায়িকাই কাজ পাওয়ার জন্য নিজের ইচ্ছায় এসবের শিকার হন। মানে ব্যাপারটা পারস্পরিক সম্মতিতে হয় আরকি। আবার অনেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও এসবের শিকার হচ্ছেন। সেটাও সত্য। তবে জনপ্রিয়তা বা কাজ হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না, এটাই হচ্ছে ব্যাপার। বাংলাদেশ জার্নাল