এখনো ভেলায় ভেসে আসছে রোহিঙ্গারা
---
কক্সবাজার প্রতিনিধি : নৌকার পরিবর্তে চারদিন ধরে ভেলায় ভেসে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। রোববার আরো ১১টি ভেলায় চড়ে প্রায় ৫০০ জন রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাংয়ের নয়াপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে সকালে দুইটি ও সন্ধ্যায় আরো নয়টি ভেলা বাংলাদেশ সীমান্তে ভিড়ে।
এদের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের উদ্ধার করে হেফাজতে রেখেছে। অসুস্থ ১০ জন রোহিঙ্গাকে সাবরাং হারিয়াখালীর অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর ধংখালীর বালুচর সীমান্ত থেকে শনিবার দিবাগত রাত ও রোববার সকাল ৭টার দিকে জোয়ারের স্রোতে ভেলা ভাসিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে এপারে পৌঁছে রোহিঙ্গারা।
জানা গেছে, মংডুর ধংখালীর বালুচর সীমান্তে দুই মাস ধরে এপারে আসতে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশি কোনো নৌকা বা ট্রলার না যাওয়ায় তাঁরা সেখানে আটকা পড়ে। এপারে আসার জন্য বিকল্প হিসেবে নিজেরা প্লাস্টিক জার, বাঁশ ও কাঠের সাহায্যে ভেলা তৈরি করে ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বুধবার একটি ভেলা আসতে সক্ষম হলে একই উপায়ে চারদিন ধরে ভেলায় চড়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে। রোববার রাখাইনের পূর্বাঞ্চলীয় বুচিডং ও রাসিডং থানাধীন ছেগামপাড়া, ধানীপাড়া, পুঁইমালি, ওয়ারিঅং এলাকার বাসিন্দারাই বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
রোববার সকালে নয়াপাড়া নাফ নদীর বেড়িবাঁধে দেখা যায়, সেগামপাড়ার সেলিমের স্ত্রী হামিদা বেগম অসুস্থ হয়ে বেড়িবাঁধে পড়ে আছেন। পাশে শুয়ে আছেন তাঁর চার সন্তান।
সেলিম জানান, তিনদিন ধরে তাঁর স্ত্রী ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত। তিনি আরো জানান, এক মাস আগে তিনি গ্রাম থেকে বের হয়ে যান। প্রথমে টানা তিনদিন ঢালাপথ অতিক্রম করে এক মাস ধরে ধংখালী বালুচরে পরিবার নিয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।
সেলিম আরো জানান, তাদের লাগানো ধান কাটতে দিচ্ছে না মিয়ানমারের বাহিনী। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
একই সীমান্ত দিয়ে সন্ধ্যায় আসা ধানিপাড়ার নূর আহমদ জানান, মিয়ানমারের সেনারা ঘরে ঘরে গিয়ে বলছে, প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে এমবিসি কার্ড নিতে হবে। না হয় রাখাইন ছাড়তে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গারা ৪০ হাজার কিয়াতের (দুই হাজার ৫০০ টাকা) বেশি বহন করতে পারবে না। তাই তিনি পরিবারের নয় সদস্যকে নিয়ে পালিয়ে আসেন।
পুঁয়াংদং গ্রামের বাসিন্দা মো. হোছন তাঁর বৃদ্ধ বাবা আবদুর শুক্কুরকে কাঁধে নিয়ে ভেলায় ওঠেন এবং এপারেও কাঁধে নিয়ে পুরো পথ অতিক্রম করেন।
ওয়ারিঅং গ্রামের বিধবা তৈয়ুবা সাত সন্তানের মধ্যে ছোট ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়েছেন। বাকি চার সন্তান কোথায় তিনি জানেন না। ১৫ দিন আগে নিজ বাড়ি ছেড়ে এপারে আসার জন্য ধংখালীতে অন্যদের সঙ্গে তিনিও নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি জানান, বড় ছেলেরা কোথাও কাজ করতে যেতে পারছে না। এমনকি নদীতে মাছ শিকারে গেলেও নির্যাতন করা হচ্ছে।
দুই সন্তান দুই কোলে নিয়ে ধানীপাড়ার ফাতেমা ঢালাপথসহ বিলঝিল পেরিয়ে ধংখালীর বালুচর সীমান্তে পৌঁছান। সঙ্গে অপর দুই সন্তান ও প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে স্বামী মো. রফিকও রয়েছেন। ছোট শিশুদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অর্ধাহারে অনাহার ও খোলা আকাশে নিচে থেকে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নৌকা না পেয়ে ভেলায় চড়ে ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করতে হয়েছে।
সাবরাং নয়াপাড়া বিজিবি বিওপির কোম্পানি কমান্ডার আতিকুর রহমান জানান, ভেলায় আসা রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করা হয়েছে। অসুস্থদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে সাগর পথে টেকনাফের মিঠাপানির ছড়া, হাবিরছড়া পয়েন্ট দিয়ে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে।
রাখাইনের বুচিডং থানাধীন পুঁইমালি গ্রামের রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে গিয়ে তারা নৌকায় ডাকাতির শিকার হয়েছে। মাঝি মাল্লারা তাদের অর্থ, স্বর্ণালংকার, সৌর প্যানেল, কাপড়-চোপড় লুট করে নিয়ে গেছে।
রোববার টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মিঠাপানিরছড়া সাগর সৈকত পয়েন্ট দিয়ে এপারে আসা রোহিঙ্গারা এ তথ্য জানিয়েছে।
আনু মিয়ার ছেলে উসমান গনি (২২) জানান, শনিবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে মংডুর ধংখালীর বালুচর থেকে জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় ইঞ্জিনচালিত একটি মাছধরার নৌকায় ওঠেন। নৌকাটি ঘণ্টা খানেক চলার পর সাগরের মধ্যখানে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। এ সময় আমার একটি ব্যাগে ১০ লাখ কিয়াত ও চার আনা স্বর্ণসহ দামি কাপড়-চোপড় ছিনিয়ে নেয় নৌকার মাঝিরা। এরপর আরো দুই ঘণ্টা পর্যন্ত নৌকা চালিয়ে সাগরের কিনারায় তাড়াহুড়ো করে তাদের নামিয়ে দিয়ে দ্রুত নৌকাসহ সটকে পড়ে তারা।
উসমান গনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমার সেনা ও মগদের নির্যাতন সইতে না পেরে প্রাণ ভয়ে এপারে চলে এসেছি। জীবনে যতটুকু সম্পদ উপার্জন করেছি তার অনেকাংশ নিজ দেশে ফেলে বাকি কিছু বিক্রি করে ১০ লাখ কিয়াত নিয়ে এদেশে আশ্রয়ের জন্য আসার সময় তাও কেড়ে নেওয়ায় এখন সব কিছু হারালাম।’ একথা বলতে বলতে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে।
আনু মিয়ার সংসারে এক স্ত্রী আয়েশা বেগম (২০)। দুই মেয়ে ফৌজিয়া আক্তার (৪) ও আনজুম আরা (২) এবং এক ছেলে মো. হাসান (১)। স্ত্রী আয়েশা এখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁকে ঢালা পথ দিয়ে কাঁধে ভর করে এই লম্বা পথ অতিক্রম করেছেন আনু মিয়া।