প্রাণঘাতী ক্যু’র মুখোমুখি পাকিস্তান
---
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :সামরিক অভ্যুত্থানপ্রবণ পাকিস্তানে আবারো একটি অভ্যুত্থানের শঙ্কা জোরালোভাবে দানা বেঁধে উঠছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এও মনে করছেন যে তেমন কিছু ঘটলে তা হবে দেশটির অস্তিত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ।
পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মার্কিন অধ্যাপক লিয়াকত আলী খান তাঁর সাম্প্রতিক এক লেখায় এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
তিনি লিখেছেন, গত ১৭ বছরে সফলভাবে বেশ-ক’টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানের গণতন্ত্র আসলে বেশ ভঙ্গুর। সামরিক বাহিনীর জেনারেলগণ, সিনিয়র আমলাবৃন্দ এবং এমনকী হাইকোর্টের বিচারপতিগণও মুখে মুখে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলেও তারা কেউই রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য হলো, এ দেশের এস্টাব্লিশমেন্টের প্রতিটি ইউনিট – তা সে হোক মিলিটারি, আমলাতন্ত্র কিংবা বিচার বিভাগ – তারা প্রত্যেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে কেবল তারাই পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম।
অধ্যাপক লিয়াকত আলী খান চাঁছাছোলা ভাষায় লিখেছেন, হামবড়া জেনারেলরা ভাবেন, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখাই দেশশাসন। এই ভেবে তারা পাকিস্তানের জনগণের সামাজিক ও গোত্রীয় জটিলতাগুলোর কথা ভুলে যান। অন্যদিকে পদোন্নতি ও ঘুষের নেশায় বুঁদ আমলাতন্ত্র দায়িত্ববোধহীনভাবে নানারকম নীতিমালা বাস্তবায়ন করে চলে। আর বিচার বিভাগ আছে পাশ্চাত্য থেকে ধার করা কিছু অখাদ্য তত্ত্ব নিয়ে। যেমন কেলসেনের থিওরি অব এফেকটিভ গভর্নমেন্ট কিংবা ডকট্রিন অব নেসেসিটি ইত্যাদি। এগুলোর সাহায্যে তারা সামরিক শাসনকে জায়েয করে করে থাকে।
এরপর অতীতের সামরিক সরকারগুলো পাকিস্তানের কী ক্ষতি করেছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে অধ্যাপক খান লিখেছেন, এবারও পাকিস্তানকে ভাঙতে একটি ফাঁদ পাতা হয়েছে, ঠিক যেন ঘাসলতাপাতা দিয়ে ঢাকা একটি গর্ত। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে ”সন্ত্রাসী রাষ্ট্র” হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাকি দুনিয়া থেকে তাকে প্রায়-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। একাজে জোট বেঁধেছে আমেরিকা ও ভারত। পাকিস্তানের যেসব ধর্মভিত্তিক সংগঠন কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের প্রতিরোধযুদ্ধকে সমর্থন দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেশটিকে চাপ দিচ্ছে তারা। যদি পাকিস্তান বা এর সেনাবাহিনী ওই গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে দেশটির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আরো জোরালোভাবে আনা হবে। আর যদি তাদের চাওয়া মেনে নিয়ে সেনাবাহিনী ওই গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে তাহলে দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে।
দেশের সামনে সমুপস্থিত এই বাস্তব হুমকিকে অজুহাত বানিয়ে বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করতে পারে সামরিক বাহিনী। যদি তা-ই হয়, তাহলে অতীতের মতো রাজনৈতিক দমনপীড়ন শুরু হয়ে যাবে, সোচ্চার রাজনীতিকদের হয় দেশছাড়া করা হবে নতুবা জেলে পোরা হবে। যেসব ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রতিবাদ করবে তাদের সামনে থাকবে দু’টো অপশন – হয় দোকান গুটাও নয়তো সামরিক সরকারের সুরে সুর মেলাও। বিদ্রোহী সাংবাদিকদের হয় অন্তরীণ করা হবে নয়তো তারা নিখোঁজ হয়ে যাবেন।
এই রাজনৈতিক শূণ্যতার সুযোগ নেবে সেই জঙ্গিরা, যারা পাকিস্তানে আইএস-এর হয়ে লড়াই করছে। নতুন পরিস্থিতিতে তারা তালিবানের সঙ্গে হাত মেলাবে। এতে গৃহযুদ্ধ তীব্রতর হবে, বাড়বে রক্তপাত। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন (মার্কিন কংগ্রেসের কতিপয় সদস্যও যার সমর্থক) গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত জঙ্গিদের ভারত খুব সম্ভব অস্ত্র যোগান দেবে। এই সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। চীনের ”ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড” উদ্যোগের ফলে যে অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তারা চাইবে এর মাধ্যমে তাকে নিভিয়ে দিতে।
নতুন সামরিক সরকারের প্রধান যিনিই হোন তাকে দেশের পরমাণু অস্ত্র সমর্পণের জন্য ভয়াবহ চাপের মুখে পড়তে হবে। শাসক জেনারেল যদি তা না করতে চান তাহলে বিশ্বমিডিয়া তাকে শয়তান দৈত্যরুপে চিহ্নিত করবে, যেমনটি করা হয়েছিল বা হচ্ছে সাদ্দাম, গাদ্দাফী বা আসাদকে। আর জেনারেল যদি মেনে নেন তাহলে তিনি হবেন শক্তিশালী।
অধ্যাপক খান পরিশেষে লিখেছেন, এবং এভাবেই পাকিস্তান নামের একটি সম্ভাবনাময় জাতিরাষ্ট্রকে দুর্ভাগ্যজনক বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দেয়া হবে। কাজেই একটি কার্যকর গণতন্ত্রকে উৎখাতের আগে জেনারেলদের উচিৎ হবে এর পরিণাম ভেবে দেখা যে কাজটি তাদের নিজেদের জন্যও কতোটা বিপর্যয়কর হবে।