বুধবার, ৫ই জুলাই, ২০১৭ ইং ২১শে আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

ষোড়শ সংশোধন: আজ আপিলের রায়

AmaderBrahmanbaria.COM
জুলাই ৩, ২০১৭

---

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বাতিল করে দেয়া হাই কোর্টের রায় বহাল থাকবে কি না, তা জানা যাবে আজ সোমবার। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের শুনানি নিয়ে গত ১ জুন আপিল বিভাগ আলোচিত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিল। রবিবার আপিল বিভাগের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, পরবর্তী দিনের কার্যতালিকায় ১ নম্বর ক্রমিকে ‘সরকার বনাম অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও অন্যান্য’ শীর্ষক মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য রাখা আছে।

গত ৮ মে আপিল বিভাগে শুনানি শুরুর পর সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা। পাশাপাশি আমিচি কিউরি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবীর বক্তব্যও শোনে আপিল বিভাগ; যাদের মধ্যে একজন বাদে অন্য সবার কথায় হাই কোর্টের রায়ের পক্ষেই অবস্থান প্রকাশ পায়।

২০১৪ সালে সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে তা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা সৃষ্টি করে। এর মধ্যে আসদুজ্জামান সিদ্দিকীসহ সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবী একটি রিট আবেদন করেন হাই কোর্টে। ২০১৬ সালে হাই কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া রায়ে সংবিধানের এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। হাই কোর্টের এই রায় নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল, সংসদে হয়েছিল ওয়াকআউট।

অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি আবার হাই কোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান জানায়। সংবিধান প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটির আপিলের শুনানি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে করার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের চাপাচাপিতে আদালতেও উত্তাপ ছড়িয়েছিল। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার উত্তপ্ত বাকবিতন্ডাও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। সংসদে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, হাই কোর্টের এই রায় ‘সংবিধান পরিপন্থী’। এটি আপিলে টিকবে না। সংসদে প্রণয়ন করা আইন উচ্চ আদালতে বাতিল করে দেয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ধরনের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগেরও সুবিবেচনা প্রত্যাশা করেন।

অন্যদিকে শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘আমরা সংবিধান মাথায় রেখেই রায় দেব।’

বিচারক অপসারণ প্রক্রিয়ার পথরেখা

বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আদালত অবৈধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলেও তাতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাই কোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রশুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়।

২০১৬ বছরের ৫ মে হাই কোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ অগাস্ট।

তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন।

হাই কোর্টের রায়ে যা বলা হয়

‘বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোনো কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪)ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।’

পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

‘সংবিধানের ৯৬ ধারাটি সংবিধান প্রণেতারা প্রথম থেকেই রেখেছেন। মাঝখানে মার্শাল ল অথরিটি বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারাই এ সংবিধানকে বিকৃত করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল প্রভিশন ঢুকিয়েছেন। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বরং আমরা সংবিধানের মূল জায়গায় ফিরে গেছি।’

এই সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের মূল কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন হয়নি দাবি করে মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘হাই কোর্ট ডিভিশন একটি ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে রায় দিয়েছেন।’

অন্যদিকে শুনানিতে রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছিলেন, সদ্য স্বাধীন দেশে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সংবিধান তৈরির সময় বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল। পরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, তাতে পরিবর্তন আনেন।

বিচারক অপসারণে অস্ট্রেলিয়া, নামিবিয়া, পাকিস্তান, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকার তথ্য তুলে ধরেন মনজিল মোরসেদ। তিনি যুক্তি দেখান, বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার অধিকার সংরক্ষিত না থাকায় বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আইনসভার হাতে থাকলে তার রাজনৈতিক ব্যবহারের আশঙ্কা থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ আদালতবন্ধু হিসেবে যে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন, তার মধ্যে কামাল হোসেনসহ নয়জনই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন। সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে অবস্থান জানান শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি।

কামাল হোসেনের সঙ্গে একই মত পোষণকারীরা হলেন টি এইচ খান, এএফএম হাসান আরিফ, এম আমীর উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এজে মোহাম্মদ আলী, এমআই ফারুকী ও আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিচি কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মতামত দেননি।

তাদের বাইরে ‘ইন্টারভেনার’ হিসেবে সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রশ্ন রেখেছিলেন, কোনো বিচারককে অপসারণের প্রক্রিয়ার সময় যদি সংসদে কোনো দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে তখন কী হবে? এর উত্তরে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতা মতিন খসরুর উত্তর ছিল, ‘সেটা পরবর্তী প্রজন্ম দেখবে।’