ফিলিস্তিনের অদম্য এক তরুণী
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :সারা দুনিয়া তার নাম জানে না, কিন্তু কেউ যদি একবারের জন্যও গাজা সমুদ্রবন্দরে বেড়াতে গিয়ে থাকেন তাহলে তিনি অবশ্যই মাদলিন কুল্লাবকে মনে করতে পারবেন।
মৎস্যজীবী বাবার মেয়ে কুল্লাব (২২) হচ্ছেন গাজার একমাত্র নারী মৎস্যজীবী। বাবার পথ ধরেই কুল্লাব এ পেশায় এসেছেন – এ কথা বলাটা পুরোপুরি ঠিক হবে না। কেননা, ছোটকাল থেকেই কুল্লাবের স্বপ্ন ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার। কিন্তু হয়নি। হাওয়া কি আর জাহাজের মন বুঝে বয়?
বাবার সাথে জীবনের প্রথমবার যখন সমুদ্রে নামে কুল্লাব, তখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর। আর স্পাইনাল কর্ডের একটা জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তার বাবা যখন কর্মক্ষমতা হারান, তখন কুল্লাব ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরী। সেই বয়সেই এই কিশোরী এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে – বাবার মাছধরা নৌকার হাল ধরবে সে।
গাজা সিটির এক প্রান্তে অবস্থিত ফিশিং হারবারের সিমেন্টের সিঁড়িতে বসে আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলছিলেন কুল্লাব। তিনি বলেন, প্রথমবার যখন মোটর বোট নিয়ে একা একা সমুদ্রে যাই, খুব ভয় লাগছিল। সেবারও ভালোই মাছ শিকার করেছিলাম আমি।
তবে নিঃসঙ্গ সমুদ্রযাত্রাটি মোটেই সহজ হয়নি এই কিশোরীর। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। প্রথমত, এই কাজে যে শারিরীক সামর্থ্য দরকার, ওই বয়সে তা তার ছিল না। তাছাড়া মেয়ে হয়ে পুরুষের কাজ অর্থাৎ মাছ শিকার করছে, এই ”অপরাধে” অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। বলা হয়, এসব পুরুষের কাজ, মেয়েদের দিয়ে এসব হয়?
অদম্য মেয়েটি এসব কথার জবাব তার কাজ দিয়েই দেবে বলে ঠিক করে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, তার মাছ শিকারের ক্ষমতা সে ওদের দেখিয়ে দেবে। সে মন-প্রাণ দিয়ে শিখে নিতে থাকে সমুদ্রে কত প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, কোন সময় জাল ফেললে বেশি মাছ পাওয়া যাবে, মাছ ধরার জন্য কোন ধরনের হুক ও রড ব্যবহার করতে হবে এবং প্যালেস্টাইনীদের কাছে কোন মাছ সবচাইতে ব্যয়সাশ্রয়ী (অবশ্যই সারডিন) ইত্যাদি।
রাতেই নিজের জাল ঠিকঠাক করে রাখতো কুল্লাব, পরদিন ভোরেই সমুদ্রে নাও ভাসাতো। মাছ যা পেতো, তা তাদের ছয় সদস্যের পরিবারকে খাইয়েও কিছু বিক্রির জন্য থাকতো।
অন্য পুরুষ জেলেরা প্রথম প্রথম তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা হাসাহাসি করলেও অচিরেই কিশোরীটি প্রমাণ করে দেয় যে, মাছ ধরায় সে তাদের চাইতে অনেক দক্ষ। প্রতিদিন সে তাদের চেয়ে অনেক বেশি মাছ ধরে। ব্যাপার দেখে তারা তো হা। কেউ কেউ আবার বলতে থাকে, জ্বিনপরীই ওকে সাহায্য করে, নইলে কেউ প্রতিদিন এত মাছ পায়?
গাজার একমাত্র নারী মৎস্যজীবী – বিষয়টি সাংবাদিকদের নজর এড়ায় না। তাই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক সাংবাদিক তাকে নিয়ে স্টোরি লিখতে ছুটে আসেন। এটিও তার পুরুষ সহকর্মীদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সময়ের ব্যবধানে সেই ঈর্ষা এখন শ্রদ্ধায় রূপ নিয়েছে। একগাল হেসে কুল্লাব জানান, আমি এখন ওদের কারো মেয়ে, কারো বা বোন।
কুল্লাব প্রথমে এই মাছ ধরার কাজে নামে বাধ্য হয়ে, পরে তা হয় শখ এবং এখন সেটি ওর পেশা। তবে গাজার মৎস্যক্ষেত্রগুলোর ওপর ইসরাইলের বিধিনিসেধ আরোপের কারণে মাছ শিকারের কাজটি এখন বিপজ্জনক হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কুল্লাব একটি সেক্রেটারিয়াল ডিপ্লোমা নেয়ার চেষ্টা করছে, যদিও সে জানে যে তাদের চাকরির বাজারটা খুবই ছোট। সে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায় যাতে কাজ ও ক্লাশ কোনোটারই ক্ষতি না হয়।
তবে যা-ই করুক, কোনো কিছুই সমুদ্রের প্রতি তার ভালোবাসাকে কমাতে পারেনি। কুল্লাব বলেন, ”আমি তো সমুদ্রের অংশ হয়ে গেছি।” সূত্র : আল জাজিরা